মাঝে মধ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রের শাখায় শাখায় অবস্হানকারী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে নানান ভূতুড়ে গল্প শোনা যায়। শুরুতে আজগুবি মনে হলেও অবশেষে গল্পগুলো প্রায় সত্যি বলে প্রমাণিত। এসব ভূতের উৎপাতে একদিকে সাধারণ জনগণ যেমন হয়রাণি হয় তেমনি দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে সচেতন নাগরিকদের অভিমত।
বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কতিপয় রাষ্ট্রদূত রয়েছেন যারা দেশের বারোটা বাজিয়ে চলেছেন। আজ এমনি এক রাষ্ট্রদূতের কথা তুলে ধরছি। আর ইনি হচ্ছেন কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. খলিলুর রহমান। ২০২০ সালের আগষ্টে তাকে সরকার অটোয়াতে নিয়োগ দেয় এরপর থেকে তিনি একে একে তার ভূতুড়ে কর্মকাণ্ড শুরু করেন।
সরকার প্রধানের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রথমে তিনি কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরীর বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন। এমন সব কাহিনী শোনাতে থাকেন যাতে মনে হয় দু’একদিনের মধ্যে তিনি নূর চৌধুরীকে হাত-পা বেঁধে প্লেনে তুলে দেবেন। অথচ তার সবগুলো বক্তব্য কেবল ফাঁকা বুলি এবং মিথ্যাচারিতায় পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের সাথে যে কানাডার কোনো ধরনের treaty নেই এটাও তিনি জানেন না এবং এক টিভি সাক্ষাৎকারে (২০ নভেম্বর ২০২২) তিনি একথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এতে স্পষ্ট বুঝা যায় কানাডিয় আইন সম্পর্কে তার জ্ঞানের অভাবে তিনি বিষয়টি কানাডিয় সরকারের কাছে উত্থাপনও করতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর খুনি প্রসঙ্গে কানাডিয় মূলধারার কোন মিডিয়াতে তার কোনো বক্তব্য কস্মিনকালেও দেখা যায়নি অথচ প্রায়ই বাংলাদেশের মিডিয়াতে তিনি তার মনগড়া তথ্য পরিবেশন করে যাচ্ছেন। প্রতিবেদনগুলো পড়লে বুঝা যায়- এই বুঝি নূর চৌধুরীকে গ্রেফতার করে প্লেনে তুলে দেয়া হলো! সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার কাছে তার এসব আজগুবি গল্পগুলোকে তিনি বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করায় পুরষ্কার স্বরুপ তাকে এক বছরের মধ্যে (২০২১ সালে) সচিব পদে পদন্নোতি দেয়া হয়। এদিকে গল্পে গল্পে তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। এবার তিনি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে সরকারকে জানালেন- আর কয়েকটি মাস তার হাতে থাকলে তিনি এ কাজটি সম্পন্ন করতে পারতেন। এটাই নাকি তার জীবনের শেষ ইচ্ছা! এমনসব তোষামোদিতে অবশেষে আবারও ছয় মাসের জন্য তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এই ছয়মাস মেয়াদ বৃদ্ধিতে জনমনে নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কেউ বলছেন এখানে তার ব্যবসা আছে। কেউ বলছেন তিনি কানাডায় থেকে যেতে পারেন! কেউ বলছেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন!
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, খলিলুর রহমান কানাডায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে আগত লুটেরাদের সহযোগি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রায়ই তাকে টরন্টোর বেগমপাড়ার লুটেরাদের অভ্যর্থনা পার্টিতে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
২০২০ সালে কানাডার সরকারি সংস্থা দ্য ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার ফর কানাডা (ফিনট্র্যাক) ১ হাজার ৫৮২টি মুদ্রা পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করার তথ্য প্রকাশ করলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন কানাডায় বাংলাদেশি ২৮ জনের অভিজাত বাড়ি থাকার তথ্য তার কাছে রয়েছে বলে জানান। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত খলিলুর রহমান বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয় তথ্যটি সত্যি নয়’।
সাধারণতঃ রাষ্ট্রদূতেরা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন; সংশ্লিষ্ট দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সুখ-দুঃখে পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু খলিলুর রহমান হলেন এর ব্যতিক্রম। অটোয়ায় রাষ্ট্রদূত হয়ে নিযুক্ত হওয়ার পরপর তিনি তার ভুতুড়ে কর্মকাণ্ড দিয়ে কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেন। শুরুতেই ‘নো ভিসা রিকোয়ারমেন্ট’ সিল সম্পর্কে তিনি নিজস্ব একটি নীতিমালা জারি করলেন। তার তৈরিকৃত এ নীতিমালায় বলা হলো যে, কোনো বাংলাদেশি কানাডিয়ান নাগরিক ‘নো ভিসা’ সিল নিতে গেলে তাকে বৈধ বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখাতে হবে। বাংলাদেশি বংশদ্ভূতদের বেলায়ও এটা প্রযোজ্য হবে বলে জানানো হলো। তিনি আরও জানালেন এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। পরে খবর নিয়ে জানা গেলো প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেননি। সরকারি আইনে যা বলা হয়েছে তা হলো, একজন বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব পরিচয়ের জন্য শিক্ষা সনদ, জন্ম সনদ, পুরনো পাসপোর্ট থাকলেই যথেষ্ট বলে গণ্য হবে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও একই নিয়ম বলবৎ রয়েছে। যখন কমিউনিটিতে ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে- তখন তিনি তার তৈরিকৃত এ নীতিমালার একাংশ বাতিল করেন (বাংলাদেশি বংশদ্ভূতদের বেলায় তার জারিকৃত নিয়ম এখনও বলবৎ রয়েছে)।
খলিলুর রহমান জানেন না প্রবাসীদের জন্য সরকারের কি কি কার্যক্রম রয়েছে, কি কি সুবিধা রয়েছে। এক টিভি সাক্ষাৎকারে তাকে ‘প্রবাসী বণ্ড’ এর কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন এ ধরনের বন্ডের নাম কখনও তিনি শোনেননি।
নিজ দেশে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আহবান জানানোর জন্য, সরকারি সুবিধাগুলোর কথা প্রচারের জন্য তিনি কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- চেষ্টা করছেন… শিগগির এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা আছে- দূর প্রবাসে কোনো প্রবাসীর মৃত্যু হলে তার লাশ স্বজনদের কাছে দেশে পাঠাতে চাইলে বাংলাদেশ সরকার এর খরচ বহন করবে। এর উত্তরে তিনি বলেন এ বিষয়টি তিনি জানেন না।
কানাডায় বাংলাদেশি কোন ব্যাংকের বৈধ এক্সচেঞ্জ নেই এ প্রসঙ্গে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি তাচ্ছিল্যভরে বলেন কানাডা থেকে বাংলাদেশে তেমন একটা রেমিটেন্স যায় না; তবে বিভিন্ন ব্যাংকের সাথে কথা হচ্ছে, কাজ চলছে।
ইন্টারন্যাশানাল ষ্টুডেন্ট কোটায় পাকিস্তানি ও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বেলায় কানাডা সরকারের স্কিম (Student Direct Scheme) থাকলেও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে এ সুবিধা জুটেনি। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অবান্তর কথা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে বলেন, ‘কাজ চলছে’।
হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী কানাডার বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। এরা কি অবস্থায় আছে, কেমন আছে, কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না এসব খবর নেয়ার সময় দূতাবাসের নেই। সরকারি খরচে লুটেরাদের পরিবারের খোঁজ-খবর নিতে সময়ের অভাব নেই!
গত ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোকদিবসের একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়নি বলে রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন আউটডোরে পতাকা অর্ধনমিত করার কথা তিনি জানেন কিন্তু ইনডোরে অর্ধনমিত রাখার বিষয়ে তিনি জানেন না। তার এ বক্তব্য শুনে হলজুড়ে ধিক্কারের শব্দ শোনা যায়।
কানাডা-বাংলাদেশের বানিজ্যের কোনো খবরাখবর অথবা কোনো উদ্যোগের খবর তার কাছ থেকে পাওয়া যায় না। অথচ কানাডা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে আয়োজিত আসন্ন ট্রেডফেয়ার ২০২৩ বন্ধ করার জন্য তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন। সম্প্রতি তার স্বাক্ষর করা একটি চিঠি ‘দেশে বিদেশে’র হস্তগত হয়েছে যেটা তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন (চিঠির কপি সংযুক্ত)। জানা যায়, তিনি এ আয়োজন থেকে পার্সেন্টেজ এবং ব্যবসায়ী দলের সাথে তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে যুক্ত করার দাবী করেছিলেন। শেষমেষ আয়োজকদের সাথে তার বনিবনা না হওয়ায় তিনি এ অপকর্মটি করেন। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে তাকে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
রাষ্ট্রদূত খলিলুর রহমানের ভূতুড়ে-কর্মের তালিকা অনেক দীর্ঘ। শীঘ্রই তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে সরকার ও দেশের আরও বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অভিজ্ঞজনেরা।
২০ নভেম্বর ২০২২ সালে দেশে বিদেশে টিভি’র লাইভ অনুষ্ঠান ‘মুখোমুখি’-তে সম্পাদক নজরুল মিন্টোর সাথে রাষ্ট্রদূত খলিলুর রহমান। (ভিডিওটি দেখতে উপরের লিংক-এ ক্লিক করুন)