রোহিঙ্গা এনআইডি বানিয়ে কোটিপতি
ঢাকা, ২৭ ফেব্রুয়ারি – মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা ও দাগি অপরাধীদের নকল পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করে দেওয়ার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট চক্রের ২৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, দালাল ও দুই আনসার সদস্য রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই অপকর্ম করে কোটি টাকার মালিক হয়েছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
গতকাল সোমবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ। গত রবিবার রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত রোহিঙ্গারা হলো উম্মে ছলিমা ছমিরা, মরিজান ও রশিদুল; রোহিঙ্গা দালাল আইয়ুব আলী ও মোস্তাকিম; আনসার সদস্য জামসেদুল ইসলাম ও মো. রায়হান; বাঙালি দালাল রাজু শেখ, শাওন হোসেন নিলয়, ফিরোজ হোসেন ও মো. তুষার মিয়া। এ ছাড়া আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, উত্তরায় কম্পিউটারের
দোকান খুলে এসব কাজে লিপ্ত দালাল মো. শাহজাহান শেখ, মো. শরিফুল আলম, জোবায়ের মোল্লা, শিমুল শেখ, আহমেদ হোসেন, মো. মাসুদ আলম, মো. আবদুল আলিম, মো. মাসুদ রানা, ফজলে রাব্বি শাওন, রজব কুমার দাস দীপ্ত, আল-আমিন ও মো. সোহাগ।
গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ১৭টি পাসপোর্ট, ১৩টি এনআইডি, পাঁচটি কম্পিউটার, তিনটি প্রিন্টার, ২৪টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরিতে সংশ্লিষ্ট শত শত দলিল জব্দ করা হয়।
পুলিশ জানায়, চক্রটি দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষের তথ্য কৌশলে নিয়ে এনআইডি বানাত। এমনই এক ভুক্তভোগী ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সাদিয়া সুলতানা সাথি। সাথি গৃহিণী, বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন নেই তার। ফলে পাসপোর্ট থাকার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তাকে টার্গেট করে তার এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে দালালচক্রের সদস্যরা এনআইডি বানিয়েছিল। তার ছবি, ঠিকানা ও এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে কক্সবাজারে থাকা উম্মে ছলিমা নামে এক রোহিঙ্গা কিশোরীর পাসপোর্ট তৈরি করেছিল তারা। শুধু সাদিয়া সুলতানা নয়, তার মতো সাধারণ নারীসহ সাধারণ পুরুষদের এনআইডি কার্ড সংগ্রহেও সক্রিয় রয়েছে দালালচক্রটি। এসব সংগ্রহের পর অন্যজনের নামে অবৈধভাবে এনআইডি কার্ড তৈরি করত তারা।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ‘চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে নকল এনআইডি ও পাসপোর্ট বানিয়ে রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দিচ্ছিল। রবিবার অভিযান চালিয়ে তাদের ধরা হয়। তারা এ অপকর্ম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদের কাছ থেকে লাখ টাকা নিয়ে জন্মসনদ তৈরি করে দেয়। গ্রেপ্তারকৃতরা কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে রোহিঙ্গাদের ঢাকায় নিয়ে আসে। এক দল তাদের জন্মসনদ বানিয়ে দেয়, আরেক দল ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাংকে জরুরি পাসপোর্ট তৈরি করতে টাকা জমা দেয়। বায়োমেট্রিক করা ও ছবি তোলার ব্যবস্থা করে গ্রুপের আরেকটি দল।’
তিনি বলেন, ‘ছয় ঘণ্টার মধ্যে জন্মসনদ তৈরির জন্য তারা ৫ থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। তিন দিনের মধ্যে এনআইডি করে দেওয়ার জন্য ২৫০০০ টাকা এবং পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নেয় বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেওয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস ও ডেলিভারি সিøপ পাওয়া গেছে। গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা ১৪৩টি পাসপোর্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি দাগি অপরাধীদের ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় পাসপোর্ট করে দিচ্ছে বলে স্বীকার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও বরিশালের ঠিকানা ব্যবহার করে জন্মসনদ ও এনআইডি বানিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে।’
হারুন অর রশীদ বলেন, ‘প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ডেটা, ডিজিটাল জন্মসনদ ডেটা, স্মার্ট এনআইডি ডেটা ব্যাংক আছে, যেখানে বিভিন্ন বায়োমেট্রিক, ছবিসহ নানা তথ্য সংরক্ষিত আছে। এসব তথ্য ভেরিফাই না করেই ইচ্ছামতো তৈরি করা কাগজপত্রের ভিত্তিতে পাসপোর্ট অফিসের দালালদের মাধ্যমে টাকা জমা দেওয়া, বায়োমেট্রিক তথ্য দেওয়া এবং পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলা যায়। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের স্মারক পাসপোর্ট তৈরির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে রোহিঙ্গা ডেটা, ডিজিটাল জন্মসনদ ডেটা ও স্মার্ট এনআইডি ডেটা যাচাই করলেই রোহিঙ্গা নন এমন বাংলাদেশিদের শনাক্ত করা সম্ভব।’
পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা গরিব পরিবারের সন্তান। তারা গত তিন বছর ধরে এসব অপকর্ম করে কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অনেকে ঢাকায় ফ্ল্যাট-বাড়িও করেছে। কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে জমিজমা কিনেছে। তাদের সঙ্গে অনেক রাঘববোয়াল জড়িত।
গত ১৮ জানুয়ারি দেশ রূপান্তরে ৪০ ভাগ রোহিঙ্গার হাতে এনআইডি শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংশ্লিষ্ট দালাল ও প্রতারকদের ধরতে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে।
সূত্র: দেশ রূপান্তর
আইএ/ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪