জাতীয়

ডাকটিকিটে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’, সমালোচনায় মন্ত্রী

ঢাকা, ৬ জানুয়ারি- বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। পাকিস্তান আমলেই ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর নাম হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’।

ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটির ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল ৪ জানুয়ারি। ওইদিন একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে নিয়ে চলছে তীব্র সমালোচনা। বলা হচ্ছে, ‘তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশবছর পালনের কী হবে?’, ‘রক্ত দিয়ে কেনা নাম, মশকরা করার জন্য নয়’, ‘এখন কি ইতিহাস রক্ষার জন্য আমরা বাংলাদেশের নামের জায়গায় পূর্ব পাকিস্তান ইউজ করবো?’, ‘তাহলে আমরা এখনও পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা???’।

আরও পড়ুন :  অনুমোদনহীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট যাচাই ৩০ জানুয়ারি

এ ধরনের আরও অনেক প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেসবুকে ছবিটি পোস্ট করা হচ্ছে।

ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ডাক ভবনে এক অনুষ্ঠানে স্মারক ডাকটিকিটটি অবমুক্ত করেন মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার নিজেই।

এরপর এদিন দুপুর ২টা ২৬ মিনিটে নিজের ফেসবুকে স্মারক ডাকটিকিটটির একটি ছবি পোস্ট করেন। ক্যাপশনে লেখেন, ‘বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে আজ।’

এর দুই মিনিট পর দুপুর ২টা ২৮ মিনিটে তিনি ছবিটি কাভার ফটো হিসেবেও আপলোড করেন। সেখানে এমন ডাকটিকিট করার কারণ জানতে চেয়েছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আমরা কি পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছি?’, ‘‘পুনরায় ‘মুসলিম’ শব্দটি সংযোজন করা কতটুকু যুক্তি-যুক্ত?’’।

এসব প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন মন্ত্রী জব্বার।

মন্ত্রীর পোস্ট করা ছবিতে শশীমোহন রায় নামে এক জন বলেছেন, ‘‘স্যার ‘মুসলিম ছাত্রলীগ’ থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে পুনরায় লেখার কারণে কি সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পাচ্ছে না? কিংবা কেবলমাত্র একটি সম্প্রদায়কে বড় করে দেখানো হচ্ছে না? যদিও বর্তমান ছাত্রলীগে অসংখ্য সনাতনী ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। তাই পুনরায় ‘মুসলিম’ শব্দটি সংযোজন করা কতটুকু যুক্তি-যুক্ত? ধৃষ্টতা হলে মার্জনা করবেন।’’

এই মন্তব্যের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘এটি ডাক টিকেট-ইতিহাস বিকৃত করার সুযোগ নাই-এটা মোটেই সাম্প্রদায়িকতা নয়। সাম্প্রদায়িকতা আপনার অন্তরে।’

জেসমিন ইসলাম মোহনা নামে এক জন মন্ত্রীর পোস্ট করা ছবিতে লেখেন, ‘আমরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। মুসলিম শব্দটা বহু আগে ছাত্রলীগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে এই শব্দ সংযোজনের কারণ কি? আমরা কি পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছি?

মন্ত্রী এর উত্তরে বলেন, ‘ডাক টিকেট ইতিহাসকে ধারণ করে। ভাবুন যদি লিখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন-তবে কতোটা সত্য আপনার নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবেন? মুসলিম লেখায় সাম্প্রদায়িকতা নেই-তখনকার প্রয়োজন ছিলো এটা- সেটা বঙ্গবন্ধু জানতেন। পরে তিনিই বাদ দেন। আমরা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ করিনি? -ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হীমন্যতা ও অপরাধ। সত্য যা তাকে মোকাবেলা করুন।’

একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কবি জাফর ওয়াজেদ তার ফেসবুক ওয়ালে ছবিটি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগ হতে পূর্বপাকিস্তান শব্দটি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে ক্রমশ অপসৃয়মান হয়ে আসে৷ একাত্তরে পুরোপুরি মুছে যায়৷ কিন্তু যেসব নেতাকর্মী পূর্বপাকিস্তানকালের, তারা সেই ধারা বহন করতেই পারেন অন্তরঙ্গে৷ তার প্রতিফলন যে ঘটানো হবে ডাকটিকিটে, বিস্ময়কর বৈকি৷ অই শব্দটি মুছে গেলে তাদের নামগন্ধ মুছে যেতে পারে, সেই আশংকায়ও হয়তো৷ তাহলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জুনে বাহাত্তর বছর পালন করবে? তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশবছর পালনের কী হবে? গোলমাল লাগছে।’

পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ আরেক পোস্টে লিখেছেন, ‘গোলাম আযমের পূর্বপাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প থমকে নেই৷ অতঃপর পূব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠার ৭২বছর হবে?’

স্মারক ডাকটিকিট ফেসবুকে আপলোড দিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গোলাম ইস্তেজা চৌধুরী মনি লিখেছেন, ‘এটা ভুল? কোনোভাবেই ভুল না। যে ডিজাইন করেছে, যে অনুমোদন দিয়েছে, সবাই জেনে বুঝে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। সাধে কি বলি যে, আওয়ামী লীগ সবাই হতে পারে কিন্তু ছাত্রলীগ সবাই হতে পারে না। ছাত্রলীগের রাজনীতি না করা এইসব আওয়ামী লীগাররা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ কোনো কিছু ধারণ করে না, করতে পারে না। তাদের ধ্যান জ্ঞান রাজনীতি বাণিজ্য।’

গণজাগরণ মঞ্চকর্মী এফ এম শাহীন লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগকে মুসলিম ছাত্রলীগে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ডাক বিভাগের সকলকে গণসংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার! এটা ভুল? কোনোভাবেই ভুল না। তারা জেনে বুঝে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হামজা রহমান অন্তর এই ডাকটিকিটের জবাবে তার ফেসবুকে ছাত্রলীগের একটা পরিচয় তুলে ধরেছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (১৯৪৮), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (১৯৫৩), ছাত্রলীগ (১৯৭১), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (১৯৭২), জাতীয় ছাত্রলীগ (১৯৭৫), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (১৯৭৬-বর্তমান)। এইভাবে বারবার বিবর্তিত হয়েছে কিংবদন্তী এই ছাত্র সংগঠন। রক্ত দিয়ে কেনা নাম, মশকরা করার জন্য নয়।’

এমন ভুলের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. আফজাল হোসেন বলেন, বিষয়টি আমি বলতে পারব না। ডাক বিভাগের মহাপরিচালক এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

আর ডাক বিভাগের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মো. সিরাজ উদ্দিন বলেন, এর আগের ডিজির সময় একটি কমিটি হয়েছিল। তখন এই ডাক টিকিট প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। আর ডাক টিকিট প্রকাশের নিয়ম হচ্ছে প্রতিষ্ঠার সময় যে নাম ছিল তা উল্লেখ করা। যারা সমালোচনা করছেন তারা না জেনে সমালোচনা করছেন।

জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সাংবাদিকদের বলেন, আপনি কি ইতিহাস মুছে ফেলবেন? কেউ যদি ইতিহাস না জানে তবে আমার কিছু করার নেই। ছাত্রলীগ পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ হিসাবেই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পরে সময়ের পরিক্রমায় নাম পালটায়। আর ডাক টিকিট ইতিহাস তুলে ধরে। আমরা ইতিহাসের সত্যটাই তুলে ধরেছি। স্মারক ডাক টিকিটে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উল্লেখ করার বিষয়টি ভুল নয় বলেও মন্তব্য তার।

মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, এখনকার সময়ে এটি করতেই পারে না। এখন কী আমরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবো? পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ হিসাবে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটলেও পরে তো সংগঠনটির নাম পরিবর্তন হয়েছে। তাই এটি করা উচিত হয়নি।

সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি

আর/০৮:১৪/৬ জানুয়ারি

Back to top button