গ্রিসের ‘কোস’ দ্বীপ (Kos Island) এজিয়ান সাগরের ডোডেকানিস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত একটি মনোরম স্থান। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে সুপরিচিত। গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ দ্বীপের অর্থনীতি মূলত পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। প্রতিবছর হাজারো পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন।
গ্রিসের এই ছোট্ট দ্বীপটিতে পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা তরুণ-তরুণীরা পার্ট-টাইম চাকরি করে ছুটি কাটায়, সৈকতের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখে। আনাস্তাসিয়া-প্যাট্রিসিয়া রুবিনস্কাও ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি পোল্যান্ডের ভ্রোৎসোয় শহরের সুন্দরি মেয়ে। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের সঙ্গে মিশে গ্রীষ্মের ছুটিকে রঙিন করতে চেয়েছিলেন। তার প্রেমিকের সঙ্গে এসে তিনি একটি পাঁচ তারকা হোটেলে কাজ নেন। দিনে পর্যটকদের হাসিমুখে খাবার পরিবেশন করতেন, রাতে সৈকতের ধারে বসে প্রেমিকের সঙ্গে গল্প করতেন।
২০২৩ সালের ১২ জুন। কোস দ্বীপের বাতাস ছিল মৃদুমন্দ। আকাশের নীলচে সীমানায় মিশে থাকা সাদা মেঘগুলোকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না, আজ এক বিভীষিকাময় ঘটনা অপেক্ষা করছে! রাতে কাজ শেষে ‘মারমারি’র ছোট্ট বাজারে ঢুকে আনাস্তাসিয়া কিছু খাবার কিনলেন। সিসিটিভির ফুটেজে তাকে দেখা গেল খাবারের জন্য টাকা দিতে। কয়েক মুহূর্ত পর, তিনি রেস্তোরাঁর এক কোণায় বসা পাকিস্তান ও বাংলাদেশি কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারা এখানে নির্মাণকাজে যুক্ত, কেউ কেউ কৃষিকাজও করেন। কিছুক্ষণ পর, আনাস্তাসিয়া তার প্রেমিককে ফোন করে বললেন, ”আমি আসছি।” তার গলাটা ছিল অস্বাভাবিক। কিছুক্ষণ পর তার দ্বিতীয় ফোন আসে। এবার কণ্ঠে আতঙ্ক, “দ্রুত এসো, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও!” প্রেমিক দৌড়ে এলেন ঠিক তার পাঠানো লোকেশনে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখলেন, আনাস্তাসিয়া নেই। চারপাশে নিস্তব্ধতা। ফোন বন্ধ, কোথাও তার কোনো চিহ্ন নেই।
পরদিন সকালে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। কোস দ্বীপজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ শুরু করে তল্লাশি। একে একে বেরিয়ে আসে রহস্যের জট। আনাস্তাসিয়াকে সর্বশেষ সিসিটিভিতে দেখা গিয়েছিল এক ব্যক্তির সঙ্গে। তার নাম- সালাউদ্দিন, বয়স ৩২ বছর। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক, কোস দ্বীপে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
গ্রিসের বাংলাদেশি কমিউনিটি বেশ পুরনো, বিশেষত এথেন্স ও থেসালোনিকিতে তাদের বসবাস অনেকদিনের। আশির দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে আসেন অনেক বাংলাদেশি। শুরুতে তারা কৃষিকাজ, নির্মাণ ও দোকানে কাজ করতেন। তারপর ধীরে ধীরে অনেকেই ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু কোস দ্বীপে বাংলাদেশি সংখ্যা তুলনামূলক কম, যারা রয়েছেন তাদের বেশিরভাগই সাময়িক শ্রমিক। সালাউদ্দিন তাদেরই একজন। পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে প্রথমে তাকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর সালাউদ্দিনের বাড়ি তল্লাশি করতে গিয়ে অনেক আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। আনাস্তাসিয়ার ডিএনএ নমুনা সেখানে পাওয়া গেল। দুটি ছুরি, হলুদ সোয়েটার- যার মধ্যে লেগে আছে রক্তের দাগ ও সোনালী চুল। আরও তল্লাশি করে খুঁজে পাওয়া গেলো অদূরে একটি গাছের নিচে আনাস্তাসিয়ার নগ্ন দেহ। একটি বিন ব্যাগের মধ্যে, ডালপালা দিয়ে মৃতদেহটি ঢাকা।
পুলিশ সালাউদ্দিনের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপে পাওয়া সার্চ হিস্টোরি চেক করে। সেখানে সালাউদ্দিন সার্চ করে- ‘কীভাবে মৃতদেহ লুকানো যায়’, ‘কীভাবে আঙুলের ছাপ মুছতে হয়’, ‘তদন্তকারীদের কিভাবে বিভ্রান্ত করা যায়’ ইত্যাদি। পুলিশ নিশ্চিত হয়ে যায় আনাস্তাসিয়ার খুনি এই সালাউদ্দিনই।
গ্রিসের পুলিশ ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আনাস্তাসিয়াকে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন যে, সালাউদ্দিন তাকে মদ্যপ অবস্থায় নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন করেন এবং পরে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। আদালত সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা- এই তিনটি গুরুতর অভিযোগ আনে।
প্রিন্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও টেলিভিশনে গুরুত্ব দিয়ে এ সংবাদ প্রচার হয়। সালাউদ্দিনের নামের পাশে লেখা হয় বাংলাদেশের নাম। গোটা গ্রিসের মানুষ বাংলাদেশিদের ধিক্কার দিতে থাকে।
এই খবরে বাংলাদেশি কমিউনিটি স্তব্ধ হয়ে যায়। কমিউনিটির নেতারা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ নির্মম ঘটনায় আমরা লজ্জিত। আমরা চাই, দোষী ব্যক্তির শাস্তি হোক; কিন্তু এর জন্য পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটিকে দোষারোপ করা উচিত নয়। আমরা বহু বছর ধরে এই দেশে পরিশ্রম করে বেঁচে আছি, আমরা সৎভাবে জীবন চালাই, এ সুনাম আমরা তৈরি করেছি।’
৬ ডিসেম্বর ২০২৪। আদালতে সালাউদ্দিন বলেন, তিনি তার ঘরে আনাস্তাসিয়ার সাথে শারিরীক সম্পর্ক করেছেন ঠিক কিন্তু তাকে হত্যা করেননি। কিন্তু উদ্ধারকৃত যাবতীয় প্রমাণ ছিল তার বিরুদ্ধে। অবশেষে, আদালত সালাউদ্দিনকে দোষী সাব্যস্থ করে রায় ঘোষণা করলো-‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’।
••• লেখাটি ‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র‘গ্রন্থ থেকে সংকলিত।