
কোভেন্ট্রি, ইংল্যান্ডের মধ্যভাগের একটি প্রাচীন শহর। একসময় শিল্প বিপ্লবের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই শহর, যেখানে গাড়ি নির্মাণ এবং টেক্সটাইল শিল্প একসময় দাপিয়ে বেড়াতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমাবর্ষণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এই শহর আবার ঘুরে দাঁড়ায়, নতুনভাবে গড়ে ওঠে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। এই শহরের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটি। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরের মতো কোভেন্ট্রিতেও অভিবাসী বাংলাদেশিরা নিজেদের জন্য তৈরি করেছেন একটি শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক। ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, টেইকওয়ে শপ, মুদি দোকান, টেক্সটাইল ব্যবসা সবকিছুতেই ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশি মালিকানার ছাপ। সপ্তাহান্তে স্থানীয় মসজিদ এবং কমিউনিটি সেন্টারগুলো হয়ে ওঠে মিলনমেলা। এখানকার বাংলাদেশিরা একে অপরকে চেনে, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়।
এই পরিবেশেই বেড়ে উঠেছিল আবদুল শাহিদ। তার বাবা-মা বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন কোভেন্ট্রিতে। তারা দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দা, কিন্তু পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
আবদুল শাহিদ ১৯৮৪ সালে কোভেন্ট্রিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোভেন্ট্রির এক নামকরা স্কুল Sidney Stringer Academy থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর স্থানীয় কলেজ থেকে ব্যবসা প্রশাসনের উপর একটি কোর্স করেন, যদিও পড়াশোনার চাইতে তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন ব্যবসার দিকে।

তার পরিবার ছিল ঐতিহ্যবাহী ও সম্মানিত। বাবা মুস্তাফিজুর রহমান স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি কোভেন্ট্রিতে একাধিক গ্রোসারি দোকান ও একটি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করতেন। মা শামসুন নাহার ছিলেন গৃহিণী, কিন্তু কমিউনিটি সেবায় তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আবদুল ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাইরা পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব সামলাতো, আর বোনেরা সংসারী জীবন বেছে নিয়েছিলেন।
শৈশব থেকেই আবদুল ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, স্বাধীনচেতা ও পরোপকারী। স্কুলের দিনগুলোতে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হয়। শিকড়ের টান অনুভব করতে থাকেন তিনি।
২০১৯ সালে মায়ের মৃত্যুর পর, আবদুল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিল পারিবারিক ভিটা দেখা এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা। তিনি দক্ষিণ সুরমার গ্রামের বাড়িতে এসে থাকেন, যেটা তার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি।
প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন মাত্র দুই সপ্তাহ থাকবেন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা তাকে আরও দীর্ঘ সময় থেকে যেতে বাধ্য করে। এখানকার পরিবেশ, মানুষ, সরল জীবনযাত্রা— সবকিছুই তাকে টানতে থাকে।
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্থানীয় এক নারীকে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে। বিয়ের পর তারা দক্ষিণ সুরমাতেই বসবাস শুরু করেন। এখানেই গত বছর তাদের যমজ কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।
যেখানে ভালোবাসা আছে, সেখানেই থাকে ঈর্ষা। আবদুল যখন তার বাবার বাড়ি সংস্কার করে একে নতুন রূপ দিতে থাকেন, তখন স্থানীয় আত্মীয়দের মধ্যে অসন্তোষ জন্ম নেয়। তারা দাবি করতে থাকে, ওই জায়গার একাংশ তাদেরও মালিকানাধীন।
এই বিরোধ শুরুতে ছিল মৌখিক, কিন্তু ধীরে ধীরে তা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। প্রথমে তার মোটরবাইকে আক্রমণ করা হয়। এরপর হত্যার হুমকি আসে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যখন তার প্রিয় কুকুরটিকে হত্যা করা হয়। কথিত আছে, প্রতিপক্ষরা তার কুকুরটিকে জীবন্ত মেরে ফেলে।
২০২৪ সালের ৭ মার্চ। রাত তখন আটটা ছুঁইছুঁই। আবদুল তার বাড়ির উঠোনে ছিলেন। হঠাৎ করেই কয়েকজন লোক অস্ত্র হাতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তিনি তখন তার বোন মিনার সঙ্গে ভিডিও কলে ছিলেন। মিনার চোখের সামনে ঘটনাটি ঘটে। তিনি দেখতে পান কিভাবে তার ভাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চিৎকার করলেও কিছুই করার ছিল না।
শরীরে একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথায় ১০ বার কোপ মারা হয়। তার পেটের একটি অংশ ফেঁড়ে ফেলা হয়, যার ফলে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসে। প্রতিপক্ষরা নির্বিকারভাবে তার নিথর দেহের পাশ দিয়ে চলে যায়।
ঘটনার পরপরই পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু হত্যাকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে পরিবার।
কোভেন্ট্রির বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এই ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠে। সবাই এ হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করে। অনেকে বলছেন, “প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ কি আদৌ নিরাপদ?”
আবদুল শাহিদের পরিবার এখন যুক্তরাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ চাইছে। তারা চান, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত হোক।
একসময় যে বাংলাদেশকে ভালোবেসে সেখানে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শাহিদ, সেই দেশই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তার রক্তাক্ত দেহ পড়ে রইলো দক্ষিণ সুরমার আঙিনায়, আর কোভেন্ট্রিতে তার পরিবার আজও অপেক্ষা করছে একফোঁটা ন্যায়ের জন্য।