
লন্ডন শহরের পূর্বাঞ্চলে একটি এলাকা ইস্ট হ্যাম। এই এলাকায় একসময় মূলত ছিল সাদা ব্রিটিশদের বসবাস, কিন্তু গত কয়েক দশকে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে একটি শক্তিশালী বাংলাদেশি কমিউনিটি। সরু রাস্তা, পাশাপাশি সারিবদ্ধ বাড়িঘর, বাংলাদেশি দোকানপাট, হালাল মাংসের দোকান, মসজিদ, বাংলা গ্রোসারির দোকান আর কারি হাউসগুলো মিলিয়ে যেন ছোট একটি বাংলাদেশ। এই এলাকার স্কুলগুলোতে বাংলাদেশি শিশুদের আনন্দমুখর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এমন একটি এলাকারই বাসিন্দা ছিল মোহাম্মদ আব্দুল শাকুর ও জুলি বেগমের পরিবার।
২০০০ সালের ১২ মার্চ, বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থেকে পর্যটক ভিসায় যুক্তরাজ্যে আসেন মোহাম্মদ আব্দুল শাকুর। পরবর্তীতে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পরিকল্পনা করেন।
তাঁর স্বপ্ন ছিল বড় ভাইয়ের মতো বিলেতে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। বড় ভাই দীর্ঘদিন ধরে কারি হাউসে কাজ করে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে উঠেছিলেন। এক বছরের মধ্যেই শাকুর বাংলাদেশ থেকে স্পন্সর করে নিয়ে আসেন স্ত্রী জুলি বেগমকে। ২০০১ সালের ৫ মে জুলি এসে পৌঁছান ইস্ট হ্যামে।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে দুই পরিবারের সম্মতিতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। তার বয়স তখন ১৯।

জুলি ছিলেন সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার এক শান্ত পরিবারের মেয়ে। শৈশব থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের জীবন গড়ার। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতা কখনো এক হয় না।
শাকুর বিলেতে স্থানীয় এক কারি হাউসে শেফ হিসেবে চাকরি পান। দৈনিক নগদ পারিশ্রমিক, থাকা-খাওয়ার সুবিধা সব মিলিয়ে তাঁর জীবন ভালই চলছিল। কিন্তু এই চাকরি তাঁর ভিসার জটিলতা দূর করতে পারছিল না। এর মধ্যে জন্ম নেয় তাঁদের দুই কন্যা সন্তান- থানহা ও আনিকা। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত জুলি চেষ্টা করেন পরিবারটিকে এক সুতোয় বাঁধতে।
কিন্তু শাকুর প্রায়ই তার স্ত্রীর প্রতি সহিংস আচরণ করতেন। মূলত তাদের দাম্পত্য বিরোধ শুরু হয়েছিল শাকুরের অভিবাসন ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা ও আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে। এছাড়াও শাকুর তাদের দুই মেয়ে হওয়ার কারণেও অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি তার সন্তানদের খুব একটা পছন্দ করতেন না। এর কারণ- তারা পুত্র সন্তান নয়।
একদিকে সংসারের খরচ চালানো, অন্যদিকে শাকুরের অভিবাসন সংক্রান্ত সমস্যা জটিল হয়ে উঠছিল। যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য তাঁর ভিসার মেয়াদ নবায়নের দরকার ছিল। ব্রিটিশ নিয়ম অনুযায়ী, তিনি স্ত্রী জুলির স্পন্সরশিপ ছাড়া স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেতেন না। কিন্তু জুলি, যার ওপর শাকুর দিনের পর দিন নির্যাতন চালাতেন, আর তাঁকে সাহায্য করতে রাজি হননি।
২০০৬ সালের শেষের দিকে তাঁদের মধ্যে কলহ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। প্রতিবেশীরা প্রায়ই তাঁদের বাড়ি থেকে উচ্চস্বরে তর্কাতর্কির শব্দ শুনতে পেতেন। জুলি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি শাকুরের ভিসা নবায়নে সাহায্য করবেন না। শাকুরের রাগ তখন আকাশচুম্বী।
২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি, নববর্ষের দিন রাতের অন্ধকারে এই পরিবারের জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। সে রাতে, তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে শাকুর তার স্ত্রীকে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করেন। এরপর, যেন তার উপর পুরনো ক্ষোভের প্রতিশোধ নিতে, একটি বালিশ দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন জুলিকে।
এতেই তার বর্বরতা শেষ হয়নি। তিনি পাঁচ বছর বয়সী আনিকাকে সাদা মোজা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন এবং ছয় বছর বয়সী থানহার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে তার খুলি ভেঙে দেন। এরপর তিনটি নিথর দেহকে চাদর দিয়ে ঢেকে তিনি বাসা ছেড়ে পালিয়ে যান।
সেদিন রাতেই একটি ট্যাক্সি নিয়ে হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে প্রথম ফ্লাইটে বাংলাদেশে পালিয়ে যান শাকুর। বাংলাদেশে পৌঁছে প্রথমে সিলেটে শ্যালিকার বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানে হত্যার কথা স্বীকার করে হুমকি দেন যে, কেউ পুলিশকে জানালে তাকেও হত্যা করবেন।
এরপর তিনি ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় গিয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকেন। সেখানে তিনি একটি ছোট রেস্তোরাঁয় কাজ নিয়ে নাম-পরিচয় গোপন রাখেন। কিন্তু ২০১৩ সালে ভারতীয় পুলিশ তাকে অবৈধ অভিবাসনের দায়ে আটক করে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১৯ সালে তাকে যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠানো হয়।
ওল্ড বেইলি আদালতে তার বিরুদ্ধে তিনটি হত্যার অভিযোগ আনা হয়। দুই দিন ধরে বিচারিক আলোচনার পর জুরি সর্বসম্মতভাবে শাকুরকে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত তাকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
রায় ঘোষণার সময় জুলির বোন শেলি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘জুলি শুধু আমার বোন ছিল না, সে ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আনিকা ও থানহা ছিল আমার মেয়েদের মতো। আমি আজও অনুভব করি তাদের।’
প্রতিবেশীরা বলেন, ‘জুলি সবসময় হাসিখুশি থাকতেন, কিন্তু তার স্বামী ছিল নিষ্ঠুর ও লোভী।’ ডিটেকটিভ সার্জেন্ট আমজাদ শরীফ বলেন, ‘শাকুরের দণ্ড এই দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সমাপ্তি টানল। তবে এটি তার স্ত্রী ও কন্যাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে না।’
ইস্ট হ্যামের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আজও এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ছায়া গভীর বেদনার চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। এক পাষণ্ড স্বামীর নির্মমতার চিহ্ন হয়ে থাকবে এই গল্পটি।