
গাছপালায় ঘেরা, শীতল হাওয়ায় মোড়ানো এক শহরতলি—নিউ ইয়র্কের কুইন্স বরোর হৃদয়ে ওজন পার্ক যেন এক স্বপ্নের নাম। বিশাল শহরের ব্যস্ততা থেকে একটু সরে এসে এখানে যারা বাস করে, তারা চায় একটু প্রশান্তি, কিছু স্বপ্নের ছায়া, আর রাতের বেলায় পাখিদের ডাকে ঘুমানোর অবকাশ। এখানে আছে সারি সারি পাতা ঝরা গাছের তলে সাজানো ঘরবাড়ি, উঠোনে বাচ্চারা খেলছে, কেউ কেউ কাজ থেকে ফিরছে ক্লান্ত পায়ে—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নবোনা আমেরিকান পাড়া।
ওজন পার্ক বহু দশক ধরে নানা জাতিগোষ্ঠীর মিলনমেলা। ১৯৭০-এর দশকে যেখানে ইতালিয়ানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, পরে সেখানে এলেন ল্যাটিনোরা, আর তারপর ১৯৮০ থেকে বাংলাদেশিদের আগমন। এখানে মসজিদ যেমন আছে, তেমনি আছে ক্যাথলিক চার্চ, সিনাগগ, হিন্দু মন্দির। সবার মাঝে একধরনের শান্তি বিরাজ করে, যেন কেউ কাউকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় না, বরং পাশে জায়গা করে দেয়।

সেই এলাকাতেই দাঁড়িয়ে ছিল আল-ফুরকান জামে মসজিদ। বাংলাদেশের হবিগঞ্জ থেকে আসা মাওলানা আলাউদ্দিন আকঞ্জী ছিলেন এই মসজিদের ইমাম। শান্ত স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করতেন, মুসল্লিদের পরামর্শ দিতেন, সমাজের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করতেন। আর তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন থারা উদ্দিন, সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে আসা এক নিরহংকারী মানুষ, যিনি পাঁচ সন্তান ও স্ত্রীসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন।

১৩ আগস্ট ২০১৬, শনিবার। গ্রীষ্মের রোদ তখন ওজন পার্কের ফুটপাথে আলতো করে ছায়া ফেলছে। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে আল-ফুরকান মসজিদে নামাজ শেষ করে বের হলেন আকঞ্জী ও থারা উদ্দিন। তাঁরা হাঁটছিলেন ৭৯তম স্ট্রিট ধরে—যেখানে সাবওয়ে ট্রেন মাঝে মাঝে গর্জন করে ওঠে, আবার থেমে যায়।
ঠিক তখনই, নিঃশব্দে একজন এগিয়ে আসে পেছন থেকে। সে গুলি চালায়, একে একে দুইজনকে মাথায়। —আকঞ্জীকে চারবার, উদ্দিনকে একবার। কোনো চিৎকার, কোনো ধস্তাধস্তি নয়। মানুষ থমকে যায়, ছুটে আসে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি। এটা ছিল না কেবল একটি হত্যা, ছিল উদ্দেশ্যহীনভাবে শান্তি ও বিশ্বাসকে লক্ষ্য করে ছোড়া আঘাত।
শোকের আবরণে ঢেকে যায় পুরো কমিউনিটি। স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। অনেকে এই হামলাকে ধর্মীয় বিদ্বেষ বা ঘৃণাজনিত অপরাধ হিসেবে দেখেন। নিউ ইয়র্কের তৎকালীন মেয়র বিল দে ব্লাসিও বলেন, “একজন ধর্মীয় নেতা নিহত হওয়া অত্যন্ত বিরল ঘটনা।”
ফাহিম অপু নামে একজন মুসল্লি বলেন, “দিনে দুপুরে আমরা রাস্তায় নিরাপদ নই, এটা ভাবতেই পারি না।”
মঈন উদ্দিন, মসজিদের যুগ্ম সম্পাদক, চোখে পানি নিয়ে বলেন, “তিনি আমাদের ইমাম ছিলেন। নামাজ শেষে সোজা ঘরে যেতেন। কারো সঙ্গে তার কোনো বিরোধ ছিল না।” যার হাতে কুরআনের পৃষ্ঠা থাকত, তার গায়ে গুলি চালানো হয়েছে।
ইমাম আকঞ্জীর ২৩ বছর বয়সী ছেলে সাইফ আকঞ্জী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমি ভাবতেই পারি না, আমার আব্বাকে এভাবে গুলি করা হবে। উনি কখনও কাউকে কষ্ট দেননি।”
৩৫ বছর বয়সী ভাতিজা আসিফ মির্জা বলেন, “আমাদের পরিবারে তিনি সবসময় শান্তি আর সহাবস্থানের শিক্ষা দিতেন। কোনো ধর্ম নিয়ে ঘৃণা করা যাবে না—এটাই ছিল তাঁর শিক্ষা।”
থারা উদ্দিনের পরিবারও থমকে গেছে। ভাই মাশুক উদ্দিন বলেন, “আমি ওকে রক্ষা করতে পারিনি। ও সবসময় আমাদের খেয়াল রাখত।” তাঁর ছেলে শিবলি আহমদ (২১) বলেন, “বাড়ি, টাকা সব ফিরে আসতে পারে, কিন্তু বাবা আর ফিরে আসবে না।”
কমিউনিটির সংগঠক খায়রুল ইসলাম কুকন বলেন, এটা পরিকল্পিত। “তাঁদের কাছে নগদ ডলার ছিল, কিন্তু সেগুলো নেয়নি। এটা কোনো ছিনতাই না।” তিনি দায় দেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদ্বেষময় রাজনীতিকে। “ওর কথায় মানুষ ঘৃণায় ভরে উঠছে। মিডিয়া যেমন ফক্স নিউজ এই বিষ ছড়াচ্ছে।”
স্থানীয় রেস্টুরেন্ট মালিক নুরুল হক বলেন, “মানুষ বুঝেই নিচ্ছে, এটা হেইট ক্রাইম। ট্রাম্পের প্রচারণায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে।”
পুলিশ শুরু করে ক্লু খোঁজার কাজ। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়—একজন ব্যক্তি গুলি চালিয়ে একটি গাড়িতে উঠে পালিয়ে যাচ্ছে। সেই গাড়ি—একটি শেভ্রোলেট ট্রেইলব্লেজার—কয়েক মাইল দূরে আরেকটি বাইসাইকেল দুর্ঘটনায় যুক্ত ছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শী গাড়ির নম্বর দেখে পুলিশকে জানান—FYY 4983।
গাড়িটি খুঁজে পাওয়া যায় ব্রুকলিনের ইস্ট নিউ ইয়র্ক এলাকায়। পুলিশ ওঁৎ পেতে থাকে। পরদিন গাড়িটির চালক যখন সেটিতে ওঠেন, তখন পুলিশের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে চেষ্টা করেন—তখনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ পরে তাঁর বাসায় হানা দেয়। কিচেনের দেয়ালে একটি ক্যালেন্ডারের পেছনে থাকা গর্তে একটি নীল ব্যাগ পাওয়া যায়—তার মধ্যে ছিল: একটি .৩৮ ক্যালিবার রিভলভার, ৫৮টি গুলি, একটি টি-শার্টে মোড়ানো পাঁচটি খালি কার্তুজ—যেগুলোর মধ্যে মৃতদের শরীরে পাওয়া গুলির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
এটি ছিল এমন এক মামলা যেখানে প্রমাণ ছিল যথেষ্ট, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। না ধর্মীয় বিদ্বেষ, না লুটপাট, না ব্যক্তিগত কোনো বিবাদ—এই হত্যাকাণ্ডের কোনো স্পষ্ট কারণ কেউ জানাতে পারেনি।
১৪ আগস্ট, পুলিশ গ্রেপ্তার করে অস্কার মোরেল নামের ৩৫ বছর বয়সী হিস্পানিক ব্যক্তিকে। তিনি ব্রুকলিনের বাসিন্দা। কেন তিনি ওজন পার্কে এলেন? কেন তিনি গুলি করলেন? তার মোটিভ কি ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না।

২০১৮ সালের মার্চ মাসে, অস্কার মোরেলকে প্রথম-ডিগ্রি হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং একই বছরের জুন মাসে তাকে প্যারোলের সম্ভাবনা ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আদালতে জেরা করেও হত্যাকারীর মোটিভ জানা যায়নি। তদন্তকারীরা বলেন, অস্কার যে রিভলভার দিয়ে গুলি চালিয়েছেন, সেটি তাঁর কিচেনের দেয়ালে লুকানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। সেই অস্ত্র এবং মৃতদেহ থেকে উদ্ধারকৃত বুলেটের মধ্যে মিল পাওয়া যায়।
মামলা চলাকালীন সময়ে প্রসিকিউটর পিটার ভি. লম্প বলেন, “আমি স্বীকার করছি, এ ঘটনার কোনো পরিষ্কার মোটিভ নেই। আমি জুরিদের বলেছি—যদি মোটিভ খুঁজতে যান, রায়ে পৌঁছাতে পারবেন না। কারণ আমরা জানি না, কেন তিনি গুলি চালালেন। এবং আইনি প্রক্রিয়ায় আমাদের এটি প্রমাণ করারও দরকার নেই।”
মোরেলের আইনজীবী মাইকেল জে. শোয়েড বলেন, মামলাটি সম্পূর্ণরূপে পারিপার্শ্বিক প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, কেউ সরাসরি মোরেলকে গুলি করতে দেখেনি। কেউ তাঁকে শনাক্ত করতে পারেনি। “শুধু এতটুকুই বলা যায়, তাঁর কাছে সেই অস্ত্র পাওয়া গেছে। কিন্তু সেটাই প্রমাণ করে না যে, তিনি গুলি চালিয়েছেন।”
মোরেল নিজের পক্ষ থেকে বলেন, “আমি নির্দোষ, মাননীয় বিচারক।”
রায় ঘোষণার আগে, ইমাম আকঞ্জী ও থারা উদ্দিনের পুত্ররা আদালতে বক্তব্য দেন। তাঁদের প্রশ্ন ছিল একটাই: “কেন? কেন আমাদের বাবাকে মেরে ফেললেন?”
বিচারক গ্রেগরি এল. লাসাক মোরেলকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন: “তুমি কি জানাতে চাও, কেন তুমি এই দুইজন মানুষকে গুলি করেছিলে?”
কিন্তু মোরেলের একমাত্র উত্তর: “আমি নির্দোষ।”
অন্য প্রান্তে, আদালতের বেঞ্চে বসা ছিলেন মোরেলের মা আনা, যিনি কাঁদছিলেন। আর বিপরীত পাশে বসা ছিলেন নিহতদের আত্মীয়-পরিজন—চোখে জল, মনে ক্ষোভ।
বিচারক অস্কারের উদ্দেশ্যে বলেন, “তুমি যা করেছো, তা চিরকাল তোমাকে তাড়া করবে। এখন হয়তো বুঝতে পারছো না, কিন্তু বছরের পর বছর, দিনের পর দিন, তুমি নিউ ইয়র্কের কারাগারের ঠাণ্ডা ইস্পাতের বার আর সিমেন্টের দেয়ালের মাঝে বসে নিজের বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করবে।”
আদালতের কাঠগড়ায় একজন বলেছিল, “আমি নির্দোষ”, আর তিন সারি দূরে দাঁড়ানো মানুষগুলো বলেছিল, “আমরা শুধু জানতে চাই—কেন?”
এই প্রশ্নটা আজও ঘুরে বেড়ায় ওজন পার্কের বাতাসে, আল-ফুরকান মসজিদের মিনারে, আর সেই ট্রেন লাইনের নিচের রাস্তার ফুটপাথে, যেখানে একদিন হেঁটে গিয়েছিলেন দুজন শান্তির দূত।
আলাউদ্দিন আকঞ্জীর কণ্ঠে তেলাওয়াতের প্রতিধ্বনি এখনও মসজিদের দেয়ালে ঘুরে ফিরে আসে। থারা উদ্দিনের পায়ের শব্দ যেন এখনো সাবওয়ে স্টেশনের দিকে যায়, যেখানে তিনি প্রতিদিন তার ছেলেকে আনতে যেতেন।
আল-ফুরকান জামে মসজিদের প্রবেশদ্বারে লেখা— “In the Name of Allah, the Most Merciful, the Most Beneficent.” শব্দগুলি যেন বাতাসে গাঁথা, হৃদয়ে খোদাই করা, প্রার্থনার ছায়ায় অনুরণিত এক চিরন্তন ঘোষণা— দয়ার আহ্বান, করুণার প্রতিজ্ঞা, শান্তির অনন্ত বার্তা।
ইমাম আলাউদ্দিন আকঞ্জী ছিলেন সেই শান্তির দূত। তিনি ছিলেন ভালোবাসার প্রতীক, নম্রতার ভাষ্যকার, আলোর পথিক। তাঁর মুখের বাণী, তাঁর হেঁটে যাওয়া পথ, তাঁর দৃষ্টির কোমলতা—সবই যেন বয়ে চলে ওজন পার্কের বাতাসে। শান্তির মানুষ কখনও মরেন না। তাঁরা থাকেন, হৃদয়ে, কণ্ঠে, বিশ্বাসে।