সম্পাদকের পাতা

বাফেলোর জেনার স্ট্রিটের দুই শহীদের গল্প

নজরুল মিন্টো

আবু ইউসুফ ও বাবুল মিয়া

বাফেলো—নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের এক প্রাচীন ও শান্ত শহর, যার বুকে ঝরে পড়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ছিটেফোঁটা কুয়াশা, আর হেমন্তের পাতাঝরা রাস্তাগুলো যেন গল্প বলে দেয় পরবাসীদের ক্লান্ত সন্ধ্যার। এই শহরে শীত নামে ধীরে, কিন্তু মানুষের হৃদয় থাকে উষ্ণ। আর এই শহরের বুকেই এক কোমল ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে একটি নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি—বাংলাদেশি অভিবাসী কমিউনিটি।

বাফেলোর বাংলাদেশি কমিউনিটি ছোট হলেও ঐক্যবদ্ধ, আন্তরিক ও পরিশ্রমী। এখানে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশি মালিকানাধীন গ্রোসারি, রেস্তোরাঁ, মসজিদ, স্কুল। এই কমিউনিটির হৃদয়ে আছে সহানুভূতি, পাশে দাঁড়াবার আন্তরিকতা, আর একজন আরেকজনের দুঃখে জড়িয়ে পড়ার সহজতা।

বিকেলের নরম রোদে আলতো করে ঝিমাচ্ছিল বাফেলোর জেনার স্ট্রিট। গাছের পাতাগুলো যখন হাওয়ায় দুলছিল নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে, তখন কে জানত কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বাতাসে মিশে যাবে মৃত্যু, রক্ত আর কান্নার গন্ধ। জীবন যেমন করে থেমে যায় এক মুহূর্তে, তেমনি থেমে গিয়েছিল দুই নিরীহ অভিবাসী পিতার স্বপ্ন—আবু ইউসুফ আর বাবুল মিয়া।

তারা দু’জনেই বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। এসেছিলেন একটু ভালো থাকার আশায়, সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর আশায়। একজন এক বছরের কম সময় আগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন বাফেলোতে, আরেকজন প্রায় তিরিশ বছর ধরে আমেরিকায় ছিলেন, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সংসার আর ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, তারা ফিরলেন না আর ঘরে—ফিরলেন না তাঁদের শিশুদের কাছে।

২৭ এপ্রিল, ২০২৪। শনিবার দুপুর। সময়টা ছিল স্থানীয় সময়ে ১২টা ৩০ মিনিট। জেনার স্ট্রিটের একটি খালি বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলেন ইউসুফ ও বাবুল। বাড়িটি বিক্রির প্রস্তুতিতে ছিল, আর সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই এই দু’জন মেরামত ও পরিস্কারের কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, ওই বাড়িটিতে ইতিমধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে একজন ‘স্কোয়াটার’ (পাদটীকা দেখুন) – একজন অবৈধ দখলদার, যে ছিল সশস্ত্র, অস্থির এবং প্রাণঘাতী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, সেই যুবক আচমকা এসে কিছু টাকা দাবি করে। তারপরেই কথা কাটাকাটি শুরু হয়, আর মুহূর্তেই বেরিয়ে আসে বন্দুক। একটি, দুটি, তিনটি গুলি। মুহূর্তের মধ্যে নিথর হয়ে যান ইউসুফ – বাড়ির বারান্দায়। বাবুল লুটিয়ে পড়েন রাস্তার উপর। তাঁকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি। তাঁর নিঃশ্বাস থেমে যায় সেখানেই।

শহর স্তব্ধ হয়ে যায়। রক্ত মিশে যায় রোদেলা দুপুরে। পুলিশের সাইরেন ছিঁড়ে ফেলে জেনার স্ট্রিটের নীরবতা। SWAT ইউনিট, হেলিকপ্টার, কড়া পাহারা – সবই তখন একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে – কেন?

নিহতদের একজন, আবু ইউসুফ, ছিলেন এক অনাগত সন্তানের পিতা। তাঁর স্ত্রী নুসরাত তাপু – অন্তঃসত্ত্বা, আর দুই শিশুসন্তান নিয়ে এখন একা। চোখের জল থামে না তাঁর। সংবাদমাধ্যমের সামনে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “আমার স্বামীকে কোনো কারণ ছাড়াই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম এই দেশে। এখন সব শেষ। আমার বাচ্চারা কীভাবে বাঁচবে?”

এই প্রশ্ন শুধু তাঁর নয়, প্রশ্নটি গুঞ্জরিত হচ্ছে পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। বাবুল মিয়াও রেখে গেছেন স্ত্রী ও সাত সন্তান। তাদের কেউ স্কুলে পড়ে, কেউ কলেজে, কেউ এখনো মুখে কথাই ফুটায়নি। অথচ এই বাবুল মিয়া ছিলেন তাঁদের ভরসার একমাত্র নাম। যিনি দিন-রাত পরিশ্রম করে টেবিলে খাবার তুলে দিতেন, যিনি হাসিমুখে কষ্টকে আড়াল করতেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য।

বুঝা যায়, এই দুই পুরুষ ছিলেন না কোনো রাজনীতিবিদ, কোনো বিখ্যাত তারকা, কিংবা প্রতিষ্ঠিত ধনকুবের। তাঁরা ছিলেন আমাদের আশেপাশের সেই সাধারণ মানুষ, যারা চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যান, পরিবারকে ভালো রাখার জন্য নিঃশব্দে সংগ্রাম চালিয়ে যান।

ঘটনার পর পুরো বাফেলো কেঁপে ওঠে। মুসলিম সেন্টারে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ইউসুফের। প্রায় দেড় হাজার মানুষ জমায়েত হন। কেউ চিনতেন তাঁকে, কেউ চিনতেন না—তবু সবাই ছিলেন সেখানে, একসঙ্গে দোয়া করার জন্য, একসঙ্গে কাঁদার জন্য। কেউ চোখ মুছছিল, কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ আবার ইউসুফের স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না।

কমিউনিটির পক্ষ থেকে সাহায্যের হাত বাড়ানো হয়। কেউ খাবার নিয়ে আসছেন, কেউ টাকা দিচ্ছেন, কেউ GoFundMe পেইজে দান করছেন। মুসলিম সেন্টারের প্রেসিডেন্ট আব্দুল মান্নান বলেন, “আমরা এটা কোনো বাংলাদেশি ইস্যু হিসেবে দেখছি না – এটা মানবতার ইস্যু।”

ঘটনার তদন্তে পুলিশ কমিশনার জোসেফ গ্রামাগলিয়া নিশ্চিত করেন, এটি হেট ক্রাইম নয়। হামলাকারী পরিচিত ছিল না ভুক্তভোগীদের সঙ্গে। তিনি বলেন, “তাঁরা কাজ করতে এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন নিরীহ মানুষ। হঠাৎই এই হামলার শিকার হন।”

বাফেলো পুলিশের তদন্তে উঠে আসে আতঙ্কের বাস্তবতা। স্কোয়াটারটি ছিল ডেল কামিংস (৩১), যার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আছে, যার মনস্তত্ত্বে ঘন কালো মেঘ। সে পালিয়ে যায় পেছনের দরজা দিয়ে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পরে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডেল কামিংস

বাফেলো শহরের মেয়র বাইরন ব্রাউন বলেন, “এই মৃত্যু কোনো ঘৃণার কারণে নয়, কিন্তু এই মৃত্যুর পিছনে যে অস্থিরতা কাজ করেছে, তা আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।” মেয়র আরও বলেন, “তাঁরা দুজনই আমাদের কমিউনিটির অংশ ছিলেন। তাঁদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব।”

এই ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের অপরাধ ছিল একটাই – তাঁরা ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় ছিলেন। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এই আমেরিকান সমাজেই কি তাঁদের স্থান ছিল না? তাঁরা কি শুধুই দিনমজুর? না কি তাঁরা ছিলেন সেই নিঃশব্দ স্বপ্নচাষী, যারা বাঁচতে চেয়েছিল একটু ভালোভাবে?

আজ তাদের সন্তানেরা হয়তো জানে না, ঠিক কীভাবে বাবারা চলে গেলেন। আজ যাঁরা দাফনের জন্য কাঁধে তুলেছেন ইউসুফ বা বাবুলের মরদেহ, তাঁদের কাঁধ ভারী হয়েছে শুধু দেহের ভারে নয় – ভবিষ্যতের দায়িত্বেও।

এখানে একটি গল্প শেষ হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে অসংখ্য। আমেরিকার মতো একটি উন্নত দেশে অভিবাসীদের নিরাপত্তা কোথায়?

ইউসুফের ছোট ছেলেটি এখনো জানে না কেন তার বাবা আর বাড়ি ফেরে না। প্রতিদিন দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন বাবার পা-চলার শব্দ শোনার আশায়। বাবুলের সাত সন্তান হয়তো এখনো অপেক্ষা করছে, কখন তাদের বাবা কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে!

পাদটীকা:
স্কোয়াটার (Squatter) বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি কোনো স্থাবর সম্পত্তি বা বাড়িতে মালিক বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে বসবাস করেন। অনেক সময় ফাঁকা বা পরিত্যক্ত বাড়িতে গোপনে প্রবেশ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতে থাকেন এরা। আইনত, তারা ভাড়াটিয়া বা মালিক নন, কিন্তু অনেক দেশের আইন অনুযায়ী তাদের উচ্ছেদ করতেও যথেষ্ট সময়, প্রক্রিয়া ও আইনি পদক্ষেপ প্রয়োজন হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের স্কোয়াটাররা প্রায়ই সামাজিক অস্থিরতা বা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, বিশেষ করে যখন তারা সশস্ত্র হন বা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকেন। এই ঘটনায় যে ব্যক্তি গুলি চালিয়েছিল, সে একজন স্কোয়াটার ছিল – এবং তার উপস্থিতি সম্পর্কে বাড়ির মালিকপক্ষও সচেতন ছিল না।


Back to top button

দয়া করে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের অনুমতি দিন

দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিজ্ঞাপন ব্লকার ব্যবহার করছেন। আমরা বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করি ওয়েবসাইটের ফান্ডের জন্য