সম্পাদকের পাতা

টেক্সাসে একটি বাংলাদেশি পরিবারের মর্মান্তিক সমাপ্তি

নজরুল মিন্টো

পরিবারের সাথে তৌহিদুল ইসলাম

শীতল বাতাসে ঝিরঝির করে উড়ছিল টেক্সাসের আকাশ। গাছের পাতারা নিরব সাক্ষী হয়ে ছিল এক গোপন অন্ধকারের। অ্যালেন শহরের এক নির্জন পাড়ায় লাল ইটের ছোট্ট একটি বাড়ি – যেখানে থেমে যায় ছয়টি প্রাণের স্বপ্ন, নিঃশব্দে। এই গল্প কোনো উপন্যাস নয়, কোনো নাটক নয় – এটি বাস্তব, মর্মান্তিক এবং আত্মার গভীরে গেঁথে থাকা এক রক্তাক্ত অধ্যায়।

তৌহিদুল ইসলাম, এক স্বপ্নবাজ মানুষ। জন্ম বাংলাদেশের পুরনো ঢাকায়, যেখানকার অলিগলি এখনো ডাকে পুরোনো দিনের গল্প বলে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তিনি ২২ বছর আগে ডাইভারসিটি ভিসা নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। দুই বছর নিউ ইয়র্কে কাটিয়ে স্ত্রী আইরিন ইসলাম ও সন্তানদের নিয়ে থিতু হন টেক্সাসের ডালাস শহরের অ্যালেন নামক শহরতলিতে। শুরু করেন নতুন জীবন – সাদামাটা, অথচ গর্বের।

তৌহিদুল ছিলেন আইটি পেশাজীবী, পরে কর্মরত হন সিটিব্যাংকে। তার স্ত্রী আইরিন ছিলেন একজন স্নেহশীলা গৃহিণী, যিনি শুধু পরিবার নয়, স্বামীর আত্মীয়স্বজনকেও ভালোবাসতেন নিজের মত করে। তাদের তিন সন্তান – তানভীর, ফারহান এবং ফারবিন – ছিলেন মেধাবী ও বিনয়ী। এই পরিবারের মুখে ছিল সদা হাসি, চোখে বিশ্বাস আর হৃদয়ে আলো।

তানভীর এবং ফারহান ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে পড়তেন, কম্পিউটার সায়েন্সে। ফারবিন, যমজ বোন ফারহানের, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পূর্ণ স্কলারশিপে ভর্তি হয়েছিলেন। পরিবারটির একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল – সেই ছবিতে হাসিমুখ, আনন্দ, জীবনের সুর।

কিন্তু এই চমৎকার বাহ্যিক সৌন্দর্যের আড়ালে ছিল এক বেদনাঘন অন্ধকার। এক অপ্রকাশ্য যন্ত্রণা, এক অব্যক্ত সংকট – যা ফুঁসে উঠেছিল নীরব আগ্নেয়গিরির মতো।

ফারহান তৌহিদ, যিনি তার সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন, “আমি নবম শ্রেণি থেকে অবসাদে ভুগছি। দিনে দু’বার নিজেকে কাটা আমার জন্য সাধারণ ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল।”

এই সন্তানদের মুখে কেউ কখনও কোনো অভিযোগ শুনেননি। অথচ ফারহান তার দীর্ঘ নোটে লিখেছেন, “আমি কাউন্সেলিং করেছি, ওষুধ খেয়েছি, কিন্তু কিছুতেই আর কাজ হচ্ছিল না। আমার ভাই তানভীরের অবস্থা ছিল আরও খারাপ। সে ছিল নিঃসঙ্গ, সামাজিকভাবে দূরে সরে যাওয়া এক আত্মা।”

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুই ভাই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন: যদি এক বছরের মধ্যে জীবনের কোনো উন্নতি না হয়, তারা নিজেরা আত্মহত্যা করবেন এবং তার আগে পুরো পরিবারকে হত্যা করবেন যেন কেউ আর দুঃখে না ভোগে। পরে তারা সিদ্ধান্ত নেন, আর এক বছর নয় – এই যন্ত্রণা আর টানতে চান না। তাই এক মাসের মধ্যেই তারা বন্দুক কিনে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নামে। ফারহানের কথায়, “যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ একটি কৌতুক। কোনো প্রমাণ চাইলো না, শুধু ফর্ম পূরণ করলেই অস্ত্র কিনে ফেলা যায়।”

৩ এপ্রিল ২০২১, শনিবার রাতে তারা হত্যা করেন মা, বাবা, বোন এবং দাদি আলতাফুন নেসাকে – যিনি বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছিলেন এবং ঠিক সেই সপ্তাহেই দেশে ফেরার কথা ছিল। তারপর নিজেরা গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

পরদিন রাত ১টার দিকে ফারহানের এক বন্ধুর কল পেয়ে পুলিশ বাড়িতে যায়। বন্ধুটি ফারহানের ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা দীর্ঘ সুইসাইড নোট পড়ে হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখতে পায় ছয়টি রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে আছে ঘরের বিভিন্ন জায়গায়। গোটা এলাকা স্তব্ধ। কেউ বুঝতে পারছে না, এত সুন্দর একটি পরিবারে এমন মৃত্যুর ছায়া কীভাবে নামলো!

স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটি ছুটে আসে। কেউ কেউ কান্না চেপে রাখতে পারেননি। পারিবারিক বন্ধু দিলারা হাসান বলেন, “তারা খুবই হাসিখুশি পরিবার ছিল। সবকিছুর মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিত। এমন কিছু কল্পনাও করতে পারি না।”

তৌহিদুলের বন্ধু শন আহসান, বলেন, “আমি রবিবার তাকে ফোন করেছিলাম, কোনো সাড়া পাইনি। সোমবার সকালে যখন খবর পেলাম, আমি আমার অফিসে বসে ২০ মিনিট নিশ্বাস নিতে পারিনি। শুধু কেঁদে গেছি।”

এতসবের মধ্যেও সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অংশ ছিল ফারহানের সুইসাইড নোটের শেষাংশ:

“আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। সত্যিই ভালোবাসি। আর এ কারণেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাদের হত্যা করব। তারা যদি বেঁচে থাকত, আমার মৃত্যু তাদের সারাজীবন কষ্ট দিত। আমি শুধু সেই কষ্টটা থেকে তাদের মুক্তি দিয়েছি। আমি জানি, আমি যা করেছি তা ভয়ঙ্কর, কিন্তু আমার কাছে এটিই ছিল সঠিক।”

সেই নোটে তিনি আরও লিখেছেন, “জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সুখ। আমি যদি সুখী না হই, তাহলে আমার বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই।”

এই পংক্তিগুলো যেন সময়ের দেয়ালে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা এক আত্মার আর্তনাদ। যেন এক নীরব চিৎকার, যে চিৎকার কোনোদিন কানে আসে না, শুধু মনের গভীরে প্রতিধ্বনি তোলে।

এই ছায়াঘন ঘটনার অন্তরালে ছিল এমন এক মানসিক অন্ধকার, যার অস্তিত্ব হয়তো কেউ কখনো বুঝেই উঠতে পারেনি। অথচ একটিবার, যদি কেউ খেয়াল করত, বুঝত, ভালোবেসে জড়িয়ে ধরত – তবে হয়তো ছয়টি জীবন রক্ষা পেতে পারতো।

ঘটনার খবর যখন বাংলাদেশে পৌঁছায়, তখন পাবনার আলতাফুন নেসার বাড়িতে শোকের মাতম ওঠে। ছেলেমেয়েরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বড় ছেলে আরিফুর রহমান আলফা বলেন, “আমার বোন (আইরিন) শুধু নিজের পরিবার নয়, আমাদেরও দেখাশোনা করত। এমন শান্ত, গুণী ছেলেমেয়ে কীভাবে এমন কিছু করতে পারে, তা ভাবতেও পারছি না।”

এই গল্প নয় কোনো কল্পকাহিনি – এ এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন, যেখানে হাসির আড়ালে চাপা থাকে অশ্রুজল, এবং নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে ডুবে যায় একটি গোটা পরিবার।

এই পরিবারটি হয়তো আর কখনো ফিরে আসবে না। কিন্তু তাদের গল্প আমাদের মনে পড়ে যাবে প্রতিটি শীতের সকালে, নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়, কিংবা যখনই আমরা ভাবব, জীবনের সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক তখনই আমরা যেন বলি – “না, আরেকটা দরজা আছে, যেটা খোলার জন্য দরকার শুধু একটু ভালোবাসা।”


Back to top button

দয়া করে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের অনুমতি দিন

দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিজ্ঞাপন ব্লকার ব্যবহার করছেন। আমরা বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করি ওয়েবসাইটের ফান্ডের জন্য