আকাশের একপাশে হালকা রঙের আলোর রেখা, আরেকপাশে জমে থাকা ধোঁয়াটে স্তব্ধতা। বাতাসে কোনো রঙ নেই, শুধু সময়ের গন্ধ। চারপাশে যেন শব্দহীন এক পৃথিবী, যেখানে পাতারা মাটিতে নামার আগে একটু থেমে ভাবে—ফিরে যাবে কি না। গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে মৌন প্রহরীর মতো, তাদের ডালপালায় সময়ের পালাবদল খেলে যায়, অথচ তারা স্থির।
শহরের ঘরবাড়িগুলো জানালার কাচের ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকে বাইরের নীরব প্রকৃতির দিকে—যেখানে দিনের আলো যেন ধীরে ধীরে পায়ের আঙুলের মতো হেঁটে আসে। অভিবাসীদের চোখে-মুখে সে আলো কখনো উদ্ভাসিত আশা, কখনো বিষণ্ন নিঃশ্বাস হয়ে ধরা দেয়।
এই সময়টা মানুষকে কিছুটা গুটিয়ে রাখে নিজের ভেতরে। ভিড় নয়, উৎসব নয়—শুধু প্রতিদিনের নিরব ধারাবাহিকতায় যাপন। যে বাড়িগুলোর আঙিনায় সকাল নামে, সেখানে প্রতিদিনই শুরু হয় এক নতুন লড়াই—যেখানে কাজের আগে প্রস্তুতির ক্লান্তি, আর কাজের পরে অনুচ্চারিত এক নিঃশব্দ স্বস্তি।
সবকিছু ঠিক আছে, শুধু মনে হয়—এই রাজ্যে দুঃখ বলে কিছু নেই, কেউ কষ্ট অনুভব করে না। যেন কষ্ট এখানে জন্ম নিতে জানে না, অথবা জন্ম নিলেও, তার মুখে শব্দ নেই।
সবকিছুতেই বাঙালিদের মধ্যে অলিখিত একটি প্রতিযোগিতা আছে। আর বাড়ি, গাড়ির বেলায়তো কথাই নেই। একদিন সন্ধ্যাবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এক স্ত্রী তার স্বামীকে বললেন, ‘আমাদের পাশের ফ্লাটের ফ্যামিলিটা বাড়ি কিনে ফেলেছে।’
স্বামী একটু চমকে উঠলেন, তারপর বললেন, “ওরা তো কানাডায় বেশিদিন হয়নি এসেছে!”
স্ত্রী বললেন- তাতে কি হয়েছে। এদের দূরদর্শিতা আছে। কণ্ঠে কটাক্ষের সুর।
জানা গেলো তাদের এক শুভাকাঙ্খী রিয়েলটর নাকি তাদেরকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করেছে। এজেন্ট বলেছে—‘শুধু শুধু ভাড়া দিয়ে কী হবে? একই টাকা দিয়ে মর্টগেজ দেয়া যায়।’ তারপর তাদের কয়েকটা বাড়ি দেখানোর পর একটি বাড়ি তাদের পছন্দ হয়েছে এবং তাদের ডিল ফাইন্যাল হয়ে গেছে।
এবার ওই রিয়েলটরের সাথে এ কর্মজীবী দম্পতির পরিচয় হয়। এজেন্ট ঐ একই কথাবলে- যে টাকা দিয়ে ভাড়া থাকেন সে টাকায় মর্টগেজ দিলে বাড়িটা নিজের হয়ে যাবে। বেসমেন্ট ভাড়া দেবেন, বাগান করবেন, ব্যাকইয়ার্ডে আড্ডা দেবেন, পার্টি দেবেন। নিজ বাড়িতে থাকার মজাই আলাদা। ব্যাস, আর যায় কোথায়? একেতো নাচুনী বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি। মহিলা অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। রিয়েলটর বলেন, এখনই বাড়ি কেনার উপযুক্ত সময়।
প্রতিদিন বিকেলে এজেন্ট সাহেব আসেন, নতুন নতুন বাড়ির ছবি দেখান। জামাই-বৌকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে সরজমিনে বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসেন। ফেরার পথে গ্রোসারী দোকান থেকে বাজার সদাই করে তাদেরকে যথাস্থানে নামিয়ে দেন। সপ্তাহ খানেক এ কার্যক্রম চলতে থাকে। এ পাড়া, ওপাড়া, এ সুবিধে, সে সুবিধে, অবশেষে তারা পছন্দ করে বাড়ি একটা কিনে ফেললো। স্বপ্নের সেই বর্ণনা। ছবির সেই বাড়ি।
নতুন বাড়ির মালিকেরা বাড়িতে উঠে বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন, বাড়ির কোথায় কি আছে দেখালেন। ভবিষ্যত পরিকল্পনাও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলেন। ব্যাকইয়ার্ডে বারবিকিউ, ছাদে সোলার লাইট, ফুলের টব। সবাই প্রশংসা করলেন, অভিনন্দন জানালেন, বললেন- বিউটিফুল হাউস!
এরপরের ইতিহাস একটি বাড়ির মালিক হওয়ার ইতিহাস। এরপরের ইতিহাস বেদনার ইতিহাস।
কিছুদিন পরেই বাস্তবতার পর্দা উঠে যায়। এক শীতের রাতে হিটার বন্ধ হয়ে যায়। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকেন তারা। পরদিন কল করা হয় মিস্ত্রিকে। ঘণ্টায় ১৫০ ডলার। কাজ হয়, কিন্তু সেই সঙ্গে শুরু হয় আরেক দুঃস্বপ্ন। একের পর এক নতুন যন্ত্রণার শুরু। আজ রান্নাঘরের ফসেট লিক করছে, কাল বাসার ছাদে পানি জমে আছে, পরশু বেসমেন্টে ড্যাম্পনেস। যন্ত্রণা আর খরচ যেন একে অপরকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে।
নিজের বাড়িতে এসে বেশিদিন তাদের সুখ সইলো না। বাড়ির মর্টগেজ বেড়ে গেলো। গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি সব মিলিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয় হয়ে গেলো বেমিল। সুখের সংসারে দেখা দিল টানাপোড়েন।
কী আর করা! স্বামী আরেকটি পার্টটাইম চাকরি নিলো। সকালে যায়, রাতে ফেরে। এদিকে স্ত্রীও আরেকটা পার্টটাইম চাকরি নিলো। এখন দুজনেই থাকে বাড়ির বাইরে। কেউ ফেরে সন্ধ্যায়, কেউ ফেরে মধ্যরাতে। আয়েশ করে বাড়ির লনে বসে চা খাওয়াটা এখনও তাদের কাছে স্বপ্ন রয়ে গেছে।
গল্প আর বাস্তব এত কাছাকাছি কানাডিয়ান তথা উত্তর আমেরিকার বাসিন্দারা ছাড়া কী অন্য কোনো দেশের লোক তা জানে?
দেয়ালের পেছনে যাদের জীবন, তাদের চোখের নিচের ক্লান্তির রেখা কেউ দেখে না। এই গল্প শুধু এক দম্পতির নয়, এটি হাজারো প্রবাসী বাঙালির নীরব অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি। স্বপ্নের বাড়ির ভেতর চাপা পড়ে থাকা বাস্তবতার নামই তো জীবন!