
৬ এপ্রিল, রোববার। নিউ জার্সির নিশুতি রাত। আকাশে তখন অল্প কিছু তারা, আর দূর থেকে ভেসে আসা গাড়ির হেডলাইটের ম্লান আলো। এলিজাবেথ সিটি থেকে ডেলাওয়ারের দিকে রওনা দিয়েছে তিনজনের এক ছোট্ট পরিবার—শরফু, তার স্ত্রী এবং তাদের নয়নমণি ছোট্ট রামিসা। আট বছরের মেয়েটির চোখে ছিল নিখাদ আনন্দ, কারণ বাবার ছুটির দিনে মায়ের সঙ্গে দূরপাল্লার ড্রাইভ মানেই তার কাছে ছিল এক মধুর উৎসব। শরফু, ফেনীর ফরহাদ নগরের সন্তান, বহু স্বপ্ন বুকে নিয়ে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। আজকের এই যাত্রাটাও ছিল এক স্বপ্নময় সন্ধ্যা কাটানোর প্রচেষ্টা।
কিন্তু কে জানতো, এই রাতটাই হবে তাদের জীবনের শেষ রজনী!
রাত সোয়া দশটা। বার্লিংটন কাউন্টির ইন্টারস্টেট-২৯৫ হাইওয়েতে যখন ‘হিউনদাই টুসন’ চালাচ্ছিলেন শরফু(৩৬), তখনই হঠাৎ এক ঝড়ের মত তাণ্ডব নেমে আসে। ফ্লোরিডা থেকে আসা ২৯ বছর বয়সী এক তরুণী তার ‘হিউনদাই সান্তা ফে’ গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেন প্রথমে গার্ডরেইলে, তারপর সেই ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে সজোরে আঘাত করে শরফুর গাড়িতে। মুহূর্তের মধ্যে দুটো গাড়ি উলটে গিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে ভাঙা কাঁচ, ইস্পাত, আর মানুষের কান্না।
একটি ছোট্ট প্রাণ, রামিসা—যার মুখে ছিল অসংখ্য প্রশ্ন, যার হাতে ছিল একটি গোলাপি পুতুল—সেই রাতে নিথর হয়ে গেল। তার বাবাও, যিনি হয়তো শেষ মুহূর্তেও মেয়েকে বাঁচাতে হাত বাড়িয়েছিলেন, চিরতরে থেমে গেলেন। শরফুর স্ত্রী, মাত্র ২৬ বছর বয়সী সেই নারী, এখনও হাসপাতালের বিছানায় অচেতন।
নিউ জার্সি পুলিশ মুখপাত্র জেফরি লেবরনের কণ্ঠেও ছিল ভারী বিষাদ। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, “এটা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার করুণ কাহিনি।”
নিউ জার্সির বাংলাদেশি কমিউনিটি যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবার চোখে জল। সবাই বলছেন, “শরফু খুব পরিশ্রমী ছিল। ফেনী থেকে এসে এসএসসি, এইচএসসি শেষ করে অভিবাসন ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসে। নিজের পরিশ্রমে ফাস্টফুড দোকানের ম্যানেজার পর্যন্ত হয়। তার মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো—রামিসা ডাক্তার হবে।”
বুধবার, ৯ এপ্রিল, সেই স্বপ্নভঙ্গের প্রতীক হয়ে বাবা-মেয়েকে পাশাপাশি কবর দেয়া হয়। জানাজায় অংশ নেয় শতশত বাংলাদেশি প্রবাসী। কেউ বলছে না কিছু, শুধু নিঃশব্দে চোখ মুছছে।
গাড়ির কাঁচ ভাঙার শব্দ হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু এক মায়ের কান্না থামেনি। হাসপাতালের বিছানায় থাকা সেই নারী হয়তো এখনও জানেন না—তার মেয়ে নেই, তার স্বামী নেই। হয়তো ঘুম থেকে উঠে বলবেন, “রামিসা কোথায়?” —তখন এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন উত্তর দিতে হবে কাউকে।
এটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি প্রবাসী জীবনের, একটি পরিবারকে ঘিরে গড়ে ওঠা স্বপ্নের, ভালোবাসার, পরিশ্রমের এবং এক হঠাৎ থেমে যাওয়া অধ্যায়ের।