
বাংলাদেশে ঘুরতে এসে কলকাতায় না গেলে আমার সফর যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতা পৌঁছে গেলাম। প্রতিবার শান্তিনিকেতন, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া কোথাও না কোথাও বেড়িয়ে এলেও একটা জায়গায় আমার যাওয়া হয়নি। সেটা ছিল বিদ্রোহী কবি, হৃদয়ের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভূমি। বইয়ের পাতায় বহুবার পড়েছি, কবি নজরুল জন্ম নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ঐতিহাসিক গ্রাম চুরুলিয়ায়। বাস্তবে সেই পুণ্যভূমির মাটির স্পর্শ নেওয়ার জন্য অন্তর থেকে ব্যাকুল ছিলাম।
আমার এই ইচ্ছের কথা বলতেই প্রিয় বন্ধু, বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সেলিম দুররানি সাগ্রহে সম্মতি জানালেন আমার সফরসঙ্গী হতে। অফিসের ব্যস্ততার মাঝেও তিনি ছুটি নিয়ে ফেললেন।
সাতই এপ্রিলের সেই ভোর ৫টায় হাওড়া স্টেশন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ট্রেনটি ছুটতে লাগল বর্ধমানের উদ্দেশে। কলকাতার নিত্য কোলাহল আর ভিড় থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে আমরা দেখছিলাম মাঠ-ঘাটের মনোরম দৃশ্যাবলি। যতটা ভেবেছিলাম, পথ তার চেয়েও দীর্ঘ। আড়াই ঘন্টা পর আসানসোল স্টেশনে পৌঁছলাম। পশ্চিম বর্ধমান জেলার একটি মহকুমার নাম আসানসোল।
সেলিম আগেই গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন। গন্তব্য চুরুলিয়া, আরও চল্লিশ মিনিটের পথ। যাবার পথে আমরা থামলাম একটি বাড়ির সামনে। বাড়িটি কবি নজরুলের নাতনি বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কাজী সোনালীর। পরম ভালবাসায় তিনি আমাদের স্বাগত জানালেন। গল্পে গল্পে এসময় কবি পরিবারের অনেক অজানা তথ্য জানলাম। তিনি “দোলনচাঁপা” নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। চুরুলিয়ার উদ্দেশে আমরা পুনরায় যাত্রা করলাম। গাইড হিসেবে আমাদের সফরসঙ্গী হলেন সোনালী কাজী।
কবিতীর্থ চুরুলিয়া। কবি নজরুলের জন্মস্থান। এই বাড়িতেই কবি কাটিয়েছেন তাঁর শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলো। কবি পরিবারের অনেক সদস্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করলেও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে পড়ে রয়েছেন পূর্বপুরুষের ভিটায়। তিনি সোনালী কাজীর পিতা। অত্যন্ত বিনয়ী, অমায়িক, গুণী এই মানুষটির উষ্ণ অভ্যর্থনায় মনটা ভরে উঠল।
একাডেমির প্রাঙ্গণে পৌঁছাতেই চমকে গেলাম। এখানে বুঝি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল অভাবনীয় এক বিরাট চমক! আমাকে সংবর্ধিত করার জন্য বিশাল এক আয়োজন! ফুলের তোড়া দেয়া হলো, উত্তরীয় পরানো হলো, ক্রেস্ট প্রদান করা হলো এবং সবশেষে গান ও কবিতা পরিবেশনা। অনেক বইও উপহার পেলাম। আমার জীবনের স্মরণীয় একটি ঘটনা স্বপ্নের চেয়েও দ্রুতগতিতে ঘটে গেলো। কবি পরিবারের আন্তরিক আতিথেয়তায় আমি বিমোহিত। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত।
কাজী রেজাউল করিম নজরুল একাডেমির সাবেক সাধারন সম্পাদক। যদিও এখন তিনি কোনো পদে নেই তবু জাদুঘরটির দেখাশোনা করে যাচ্ছেন। জানালেন ইতিমধ্যে জাদুঘরটি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছেন। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখালেন নজরুল একাডেমির অমূল্য সংগ্রহশালা। দেখালেন তাঁদের পিতৃপুরুষের অনেক স্মৃতিচিহ্ন। কবির স্মৃতি বিজড়িত প্রতিটি বস্তু দেখতে দেখতে হৃদয় হয়ে উঠল আবেগে সিক্ত।
দুপুরে তাঁর বাড়িতে আমাদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। কবি-পরিবারের অন্তরের মমতায় আপ্লুত হয়ে গেলাম। দিনভর গল্প হলো নজরুলের জীবন নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে। সন্ধ্যা নামার আগেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায় নিলাম কাজী রেজাউল করিমের কাছ থেকে। মনে মনে প্রতিশ্রুতি দিলাম—আবার আসব।
আজ হঠাৎ সংবাদ পেলাম, তিনি আর নেই। গত ২৯ মার্চ ২০২৫-এ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বুকের ভেতরটা যেন হাহাকারে ভারী হয়ে উঠল। এই তো সেদিন তাঁর হাসি, তাঁর কথা, তাঁর আন্তরিকতার স্পর্শ অনুভব করে এলাম। কত গল্প বাকি ছিল, কত স্মৃতি ভাগ করে নেওয়ার ছিল। এক অমায়িক, নিরহংকার, কবির উত্তরাধিকার বুকে নিয়ে চলা মানুষটি আজ আর নেই—এ কথা ভাবতেই চোখের কোণে অশ্রু এসে ভিড় করল। প্রার্থনা করি, তাঁর মহৎ আত্মা চিরশান্তি পাক। তাঁর স্মৃতি হৃদয়ে জাগরুক থাকবে চিরকাল।