সম্পাদকের পাতা

রেহানার গল্প: অস্ট্রেলিয়ায় শুরু, আশুলিয়ায় সমাপ্তি

নজরুল মিন্টো

রেহানা পারভিন

অষ্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের লকিয়ার ভ্যালি। সবুজ পাহাড়ের আলতো ঢেউয়ে বয়ে চলা একটি কৃষিবান্ধব অঞ্চল, যেখানে আকাশটা একটু বেশি নীল, বাতাসটা একটু বেশি মিষ্টি, আর সময় যেন ধীরে হাঁটে।

এই উপত্যকা অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত, যেখানে নানান ধরনের ফল-ফসলের ঘ্রাণে ভরে থাকে বিকেলবেলা। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, এই শান্ত পরিবেশেই ছিল রেহানা পারভিনের স্বপ্নের বাড়ি। এখানেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি গ্রোসারি দোকান। ছিলো নিজের গাড়ি।

রেহানার দিন শুরু হতো সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে, ব্যবসা দেখাশোনা করে। অস্ট্রেলিয়ার নিরবচ্ছিন্ন কর্মচঞ্চল জীবনে রেহানা ছিলেন—একাধারে মা, শিক্ষার্থী, উদ্যোক্তা ও স্বপ্নপথের পথিক। এরিমধ্যে বেশকিছু জমিজমাও তিনি কিনে নেন। তার নামে ছিলো টারায় ১৪ হেক্টর জমি, ইনালা ও রিভারভিউতে তিনটি বাড়ি। শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, বাংলাদেশেও তাঁর নামে ছিল বেশ কিছু সম্পদ।

সম্পত্তির পাশাপাশি তিনি গড়ে তুলেছিলেন সংসার—স্বামী আওলাদ হোসেন ও পাঁচ সন্তান নিয়ে। সন্তানদের নাম—আহাদ নূর, জিয়াদ, সামিন, হাফসা এবং ছোটজন মালিহা। আহাদ নূর ময়মনসিংহের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে, রেহানার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে একজন ডাক্তার বানাবেন। ছেলে জিয়াদ খেলাধুলায় ভালো, রেহানা চেয়েছিলেন সে হয়ে উঠুক একজন ফুটবল খেলোয়াড়, আর বাকিদের জন্য ছিল তার অগাধ স্বপ্ন—ভালো মানুষ হওয়া।

রেহানা-আওলাদের বিয়ে হয়েছিল ২০০৩ সালে, বাংলাদেশে। ২০০৪ সালের শুরুর দিকে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় যান। প্রথমে গিয়েছিলেন আওলাদ হোসেন, কয়েক মাস পর নিয়ে যান রেহানাকে। নাগরিকত্ব লাভ করেন ২০০৮ সালে।

কথিত ঘাতক স্বামী আওলাদ হোসেন

রেহানার বাবা লেহাজ উদ্দিন ও মা ইরেন আক্তার ছিলেন শিক্ষাবান্ধব মানুষ। মেয়ে রেহানার লেখাপড়ার জন্য তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ইরেন আক্তার বলেছিলেন, “আমি নিজের স্বপ্ন ভেঙে মেয়ের ভেতর স্বপ্ন বুনেছিলাম।” রেহানাও বলতেন, “বাংলাদেশে একটা স্কুল গড়বো একদিন।”

আওলাদ হোসেনের জন্মস্থান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার ছোট রাজপাড়া গ্রাম। তাঁর বাবা মৃত আব্দুল মান্নান, পেশায় ছিলেন একজন কৃষক, মা রহিমা বেগম ছিলেন গৃহিণী। পেশায় আওলাদ ছিলেন রেস্তোরাঁ কর্মী, পরে ড্রাইভিং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।

সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সংসারে সুখ ছিলো না। ছিল কলহ, ছিল অবিশ্বাস, ছিল অদৃশ্য বিভাজন।দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকতো। ২০২০ সালের পর থেকে তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। রেহানা তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বামীকে অনুপস্থিত রেখে এককভাবে জীবনযাপনের ছবি প্রকাশ করতেন। এছাড়া অষ্ট্রেলিয়ায় ক্রয়কৃত সকল সম্পত্তি তিনি নিজের নামে করে রাখেন, যা নিয়ে তাঁদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে টানাপোড়েন চলছিল।

২০২৪ সালের ৬ জুন, রেহানা তাঁর ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। উদ্দেশ্য, মেয়ে আহাদ নূরকে ময়মনসিংহের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানো, এবং পাশাপাশি সম্পত্তি দেখাশোনা। ঢাকায় নামার পর এক রাত কাটিয়েছিলেন বাবার বাড়িতে, এরপর গিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়িতে।

২৯ জুন, তাঁর স্বামী আওলাদ হোসেনও বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। কিছুদিন পরে, ৩ জুলাই, রেহানা ফোন করে জানান—তিনি হাসপাতালে, গর্ভপাত হয়েছে। তিনি তখন ছিলেন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। চিকিৎসা নিয়েছিলেন নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে পাঠানো হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই ছিল তাঁর শেষ কণ্ঠস্বর। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই।

৩১ আগস্ট, দুই মাস নিখোঁজ থাকার পর রেহানার মা ইরেন আক্তার নবাবগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ৮ সেপ্টেম্বর, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা করেন: তাঁর মেয়ে অপহৃত হয়েছেন—অভিযোগের কেন্দ্রে স্বামী আওলাদ হোসেন, ননদ পাপিয়া আক্তার, অপর ননদ মাকসুদা বেগম এবং চাচা আমজাদ হোসেন।

১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পুলিশ গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পাপিয়া আক্তারের বাড়ির উঠানে সেফটি ট্যাংকের পাশে খোঁড়াখুঁড়ি করে। সেখানে পাওয়া যায় রেহানার অর্ধগলিত মরদেহ। এই গর্তে সে ছিল নিঃশব্দ, নির্বাক, নির্মমতার সাক্ষ্য হয়ে।

পুলিশ পাপিয়া আক্তারের বাড়ির উঠানে খোঁড়াখুঁড়ি করে। যেখানে পাওয়া যায় রেহানার অর্ধগলিত মরদেহ।

পুলিশের তদন্তে জানা যায়—৩ জুলাই রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে রেহানাকে হত্যা করা হয়। খুন করা হয় বালিশচাপা দিয়ে।

পুলিশ সুপার আহম্মদ মুইদ বলেন, “আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পাপিয়া ও আমজাদকে গ্রেফতার করি। তাঁদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। রেহানার স্বামী আওলাদ হোসেন ছিলেন মূল পরিকল্পনাকারী।” উদ্দেশ্য ছিল রেহানার সম্পত্তির মালিকানা দখল।

আওলাদ হোসেন ১৩ জুলাই অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান। বাংলাদেশ পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়ে আবেদন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থাপত্র রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ (AFP) নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে এসে তদন্ত চালায়। তাঁরা নিশ্চিত করে বলেন, এটি এখন ‘সন্দেহভাজন হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং তদন্ত চলছে কমনওয়েলথ ক্রিমিনাল কোড অনুযায়ী।

পুলিশ জানায়, রেহানার মৃত্যুর পর আওলাদকে সন্দেহ করা হয় কয়েকটি কারণে—(১) রেহানা নিখোঁজ হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর তিনি গোপনে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান; (২) তাঁর পরিবার থেকে অভিযোগ আসে যে সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই রেহানাকে হত্যা করা হয়; (৩) রেহানার ননদ ও স্বামীর ঘনিষ্ঠজনেরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

অস্ট্রেলিয়ায় এই ঘটনা শুরুতে তেমন একটা আলোড়ন তোলে না। স্থানীয় কেউই জানত না রেহানার মৃত্যু সম্পর্কে। ABC নিউজ, ডেইলি মেইল, দ্য অস্ট্রেলিয়ান—যখন একের পর এক রিপোর্ট ছাপাতে শুরু করে, তখন কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ কমিউনিটি। অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ (AFP) নিজ উদ্যোগে তদন্ত শুরু করে।

রেহানার মৃত্যুর বিষয়ে আওলাদ হোসেন এখনও কোনো প্রকাশ্য বক্তব্য দেননি। ডেইলি মেইল ও ABC-এর অনুসন্ধানে জানানো হয়েছে যে, তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ এড়িয়ে চলেছেন এবং কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ব্রিসবেন ও সিডনির কমিউনিটি নেতারা গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ডা. জিষ্ণু দাস গুপ্তা, একজন বিশিষ্ট প্রবাসী নেতা বলেন, “এটি একটি মর্মান্তিক ও অগ্রহণযোগ্য ঘটনা। আমরা রেহানার পরিবারের পাশে আছি এবং ন্যায়বিচার চাই। পাঁচটি সন্তান যেন বিচার দেখতে পায়, সেটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা।”

নারী সংগঠনগুলো “justice for Rehana” শিরোনামে অনলাইন ক্যাম্পেইন শুরু করে। তারা অস্ট্রেলিয়ান সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়, যেন আওলাদ হোসেনকে প্রত্যর্পণ করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

সামাজিক মাধ্যমে রেহানার ভিডিও এবং বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর “নারীরা কোনো সম্পত্তি নয়”—এই বক্তব্য বিশেষ করে নারীবাদী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষার্থী ও অভিভাবক স্মরণসভা আয়োজন করে রেহানার সম্মানে। তাঁর মেয়ে আহাদ নূর সেখানে বলেন, “মা শুধু আমাদের মা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এই প্রজন্মের নারীদের আত্মবিশ্বাসের উৎস।”

রেহানার মা ইরেন আক্তার কাঁদছিলেন আর বলেছিলেন—“আমি অনেক কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করেছি, বিদেশে পাঠিয়েছি, নাগরিকত্ব পেয়েছে, নিজে উপার্জন করেছে, জমি কিনেছে। আর সেই মেয়েকে ওরা মেরে ফেললো।”

তিনি বলেন, “আমি আমার মেয়ের ন্যায়ের জন্য লড়ব। আমি চাই এই পৃথিবীর কোনো মা যেন আর এভাবে মাটিচাপা না পড়ে।”


Back to top button

দয়া করে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের অনুমতি দিন

দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিজ্ঞাপন ব্লকার ব্যবহার করছেন। আমরা বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করি ওয়েবসাইটের ফান্ডের জন্য