
পূর্ব লন্ডনের ক্যানিং টাউন—যে এলাকা এখনও পুরনো বন্দরের স্মৃতি বয়ে বেড়ায়। এখানে ছড়িয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের জীবনচক্র—নির্মাণকর্মীর ঘাম, হকারের হাঁকডাক, আর দোকানের জানালায় সাজানো হালাল মাংস আর ইরানি ডালচিনি। এখানে দোকানের নাম বাংলা, উর্দু কিংবা ফারসিতে লেখা। রেললাইন ধরে হেঁটে গেলে দেখা যায় ব্যস্ততা, আরেকদিকে স্তব্ধতা। কেউ হাঁটে দিকভ্রান্ত ভিনদেশি শ্রমিকের মতো, কেউ দাঁড়িয়ে থাকে দোকানের সামনে নির্বাক। দিনের আলো এখানে ধূসর, আর রাত আসে কিছুটা বেশি দ্রুত, যেন সময় এখানে নিজেই ক্লান্ত।
এই এলাকায় বসবাস করতেন আয়েশা। পায়ে হালকা চটি, কাঁধে ব্যাগ, আর মুখে একরাশ চিন্তার ছায়া নিয়ে তিনি হেঁটে যেতেন স্থানীয় স্কুলে, যেখানে তিনি একজন শিক্ষক সহকারীর চাকরি করতেন।
আয়েশার জন্ম বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলায়, এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। পরিবারে তিন ভাই, দুই বোন। বাবা ছিলেন শিক্ষক, মা একজন ধর্মপ্রাণ গৃহিণী। সবার ছোট আয়েশা ছিল সবার প্রিয়। তার পড়াশোনা শেষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর, ভাগ্য বদলের আশায় পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত হয়—উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে পাঠানো হবে ইংল্যান্ডে।
২০০৯ সালে শিক্ষার্থী ভিসায় লন্ডনে পা রাখেন আয়েশা। সেখানে শুরু হয় তার নতুন জীবন। টিউশন, অস্থায়ী কাজ, আত্মীয়ের আশ্রয়। কিন্তু তিনি ছিলেন লক্ষ্যে স্থির। স্থানীয় একটি ইসলামিক স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানেই পরিচয় আসিম হাসান নামের এক যুবকের সঙ্গে।
আসিম তখন ক্যানিং টাউনের এক হালাল রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এই যুবক লম্বা, ছিমছাম, আর মুখে সবসময় মিষ্টি হাসি রাখত। শুরু হয় কথাবার্তা, তারপর কিছুদিনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা।
২০১১ সালের শেষ দিকে দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ের। আয়েশার পরিবার এই বিয়েতে প্রথমে সায় না দিলেও শেষমেশ মেয়ের ইচ্ছায় সম্মতি দেয়।
আসিমের বাহ্যিক ভদ্রতা ও ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে ছিল এক অপরিণত, রূঢ়, সন্দেহপ্রবণ মন। বিয়ের পর ধীরে ধীরে সেই মুখোশ খসে পড়তে থাকে। প্রথমে কথার বঁড়শি, পরে দৃষ্টির তির, তারপর ধীরে ধীরে শরীরেও আঘাত।

প্রথম দিকে আয়েশা এই পরিবর্তন মেনে নিতে চেষ্টা করে। ভেবেছিল হয়তো সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তার জীবনে অন্ধকার বাড়তে থাকে। স্বামীর সন্দেহ, গালাগালি, মাঝেমধ্যে ধাক্কাধাক্কি—সব মিলিয়ে আয়েশা বুঝে যায়, সে আর নিরাপদ নয়।
সে তখন নিজের মোবাইলে শুরু করে আসিমের সহিংসতার রেকর্ড রাখা। গোপনে তুলে রাখে নিজের মুখের ছবি—চোখের নিচে কালশিটে, ঠোঁটে কাটা দাগ, কানের পাশে আঁচড়ের চিহ্ন। ফোনে একটি ফোল্ডার বানায়—”Hidden”, যেখানে রাখে সেই ছবিগুলো।
তার ভয় ও যন্ত্রণা জানত কেবল তার হোয়াটসঅ্যাপের বন্ধুরা—সাবিহা, তানজিনা, সানজিদা। তারা তাকে সাহস দিত, পুলিশে যাওয়ার কথা বলত। কিন্তু আয়েশা বলত—“আমি চাই না ওর বড় ক্ষতি হোক। আমি শুধু চাই সে আমাকে ছেড়ে চলে যাক।”
২০২২ সালের ৯ মে, আয়েশা তার বন্ধুদের এক “চিলিং” বার্তা পাঠায়—“আজ বাসায় কেউ না থাকলে সে আমাকে মেরে ফেলত। আমি আর নিরাপদ নই।”
পরদিনেও সে রেকর্ড করে, যেখানে শোনা যায়—“পরেরবার তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। আমি সেটা চাই না।”
আয়েশা জানতেন কী আসছে, কিন্তু অপেক্ষা করছিলেন… কীসের জন্য? হয়তো নিজের ভিতরে একটা শেষ আশার জন্ম হয়েছিল, যা সে নিজের অজান্তেই লালন করছিল।
১৯ মে, ভোরবেলা, আসিম ৯৯৯-এ ফোন করে বলে: “আমি আমার স্ত্রীকে ছুরি মেরেছি।”
পুলিশ গিয়ে দেখে, রান্নাঘরের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আয়েশা। তার হাতে রক্ষার ক্ষত, মাথায় একটি আঘাতে খুলির হাড় ভেঙে গেছে। তার রক্ত চারপাশে ছড়িয়ে ছিল যেন তার অক্ষম চিৎকারের অনুবাদ।
কালো হাতলের একটি রান্নাঘরের ছুরি পড়ে ছিল চুলার পাশে—নির্মম সাক্ষী হয়ে।
আয়েশার বান্ধবী সাবিহা আদালতে কাঁদতে কাঁদতে বলেন—“ও বলেছিল, সে শুধু নিরাপত্তা চায়। কিন্তু সে পায়নি।”
সানজিদা বলেন—“আমরা অনেকবার বলেছি পুলিশে যেতে, ও বলত, ‘সে যদি গ্রেপ্তার হয়, তার পরিবার কী করবে?’ সে ভেবেছিল নিজের দুঃখকেও যেন সম্মানের ভেতর ঢেকে রাখতে হবে।”
আটকের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আসিম বলে—“আমি দোষী। আমাকে চার্জ করুন।”
তার আইনজীবী আদালতে বলেন, হত্যার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু প্রসিকিউটর বলেন—“৩৬টি ছুরিকাঘাত, যার একটিতে খুলি থেকে হাড় আলাদা হয়ে যায়—এগুলো কোনো আকস্মিক রাগের বহিঃপ্রকাশ নয়। এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মৃত্যু নিশ্চিত করার কৌশল।”
ওল্ড বেইলি আদালতে বিচারক রায় পড়েন—“আজীবনের কারাদণ্ড, ন্যূনতম ২১ বছর”।
আর এক নির্মম বাস্তবতা—হত্যার ঠিক কদিন আগে আসিম এক মুসলিম ডেটিং সাইটে একজন নারীর সঙ্গে চ্যাটে জড়ায়।
আয়েশার জানাজা হয় ইস্ট লন্ডনের বার্কিং মুসলিম সেন্টারে। কফিনে মোড়ানো শরীরের পাশে ছিল তার বড় ভাই সেলিম। তিনি বলেন: “আমার বোন চুপচাপ ছিল, কিন্তু তার ভেতরটা ছিল এক যুদ্ধক্ষেত্র। সে মরার আগে রক্ষা চেয়েছিল, কিন্তু কেউ শুনল না।” তিনি তার বোনের মৃত্যুর বিচার চান।
ক্যানিং টাউনের আকাশ সেদিন যেন একটু বেশিই ধূসর ছিল। আয়েশার জন্য কেউ ফুল রাখে লেম্যান স্ট্রিটের গলিতে। সেখানে লেখা থাকে, “She tried. But no one heard.”