
বেথনাল গ্রিন – লন্ডনের পূর্বদিকের এক প্রাণবন্ত জনপদ, যেখানে পুরনো ইটের বাড়িগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে আত্মবিশ্বাস নিয়ে, যেন প্রতিটি দেয়াল নিজের গল্প বলে।
গ্লোব রোড – এই পথটা শুধুই রাস্তা নয়, এটি বহু অভিবাসী জীবনের প্রান্তর, যেখানে দক্ষিণ এশিয়া আর ইউরোপ একসাথে ঘর বাঁধে। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানগুলোয় বাংলা ও ইংরেজি মিলেমিশে এক নতুন ভাষা তৈরি করেছে। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে হালাল মাংসের দোকান, মসজিদের মাইকের ধ্বনি সব মিলিয়ে এই এলাকা যেন এক আশাবাদী প্রবাসজীবনের আলোকচিত্র।
এখানেই এক তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন ইয়াসমিন বেগম। ছিমছাম একটি ফ্ল্যাট। জানালার পাশে ছোট ছোট গাছ, দেয়ালে বাচ্চাদের আঁকা রংতুলির ছবি—সব মিলিয়ে এক শান্ত, স্নিগ্ধ গৃহকোণ। তিনি ছিলেন একজন মা, একজন কর্মজীবী নারী, আর একজন প্রতিবেশী যিনি হাসি দিয়ে মন জয় করতেন। নিজের হাতে সাজানো সংসার। দুই সন্তান নিয়ে এক অদৃশ্য স্বপ্নে গড়া জীবন। বড় ছেলে নয় বছর বয়সী আর ছোটটি চার। ইয়াসমিন ভোরে উঠে নাশতা বানাতেন, গায়ে ওড়না জড়িয়ে বাচ্চাদের রেডি করে স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
এই কমিউনিটিতে ইয়াসমিন ছিলেন পরিচিত মুখ – ক্লাসরুমের করিডোরে, কিংবা প্রতিবেশী কারও অসুখে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়ানো মানুষ। তাঁর জীবনে ছিল স্বপ্ন, দায়িত্ব, আর অদম্য মমতা – যা ছড়িয়ে ছিল তার সন্তানদের চোখে-মুখে, আর তার ছোট্ট ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণায়। ইয়াসমিন বেগমের জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জে। ২০০০ সালের দিকে, বাবার হাত ধরে লন্ডনে এসেছিলেন, বয়স তখন আঠারো। এরপর পড়াশোনা শেষ করে ব্রিকলেইনের ছোট্ট এক দোকানে কাজ শুরু করেন, পরে স্থানীয় একটি স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক সহকারীর চাকরি নেন। সময়ের সঙ্গে শিখে ফেলেন ট্রেন ধরার তাড়াহুড়ো, কাগজপত্রে নাম লেখানোর কায়দা, আর ভাষার ভেতর হারিয়ে যাওয়া নিজের ছায়া খুঁজে নেওয়া।
২০০৫ সালে পারিবারিক আয়োজনে বিয়ে হয় কাইয়ুম মিয়ার সঙ্গে। কাইয়ুম, পূর্ব লন্ডনের হোমারটনের বাসিন্দা। তার বাবা-মা বাংলাদেশের হবিগঞ্জের মানুষ হলেও কাইয়ুমরে জন্ম এবং বড় হওয়া এই শহরে। ট্যাক্সি চালানো, মাঝেমধ্যে কিচেনে কাজ, আর বন্ধুদের সঙ্গে রাতভর আড্ডা—এই ছিল কাইয়ুমের জীবন।
শুরুতে সবকিছু ভালোই চলছিল। একে একে দুই সন্তান জন্ম নেয়। ইয়াসমিন তাদের মানুষ করার স্বপ্নে বাঁচতেন, অথচ কাইয়ুম শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আর সেই মাদক তাকে ধীরে ধীরে মানুষ থেকে অমানুষ বানিয়ে দেয়।
কাইয়ুম যখন তখন টাকা চাইত, ঝগড়া করত, কখনো মারধর করত। ইয়াসমিন অনেক চেষ্টা করেও সংসার টিকিয়ে রাখতে পারেননি। ২০২১ সালে তারা আলাদা হয়ে যান। প্রায় এক বছর ধরে তারা আলাদা থাকতেন এবং বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছিল।
বিচ্ছেদ তখনও হয়নি। কাইয়ুম মাঝে মাঝে সন্তানদের দেখতে আসত, কখনো দেখা করত না। ইয়াসমিন তাকে আর ফিরিয়ে নিতে চাননি। কাইয়ুমের পরিবার—তার মা, দুই ভাই, এক বোন—সবাই হোমারটনেই থাকত। কিন্তু কারো সঙ্গেই ইয়াসমিনের যোগাযোগ ছিল না।
ইয়াসমিনের স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা, কিন্তু সংসারের দায়, সন্তানদের ভবিষ্যত—সবকিছু তাকে বাস্তবের কঠিন মাটিতে দাঁড় করিয়ে দেয়।
বেথনাল গ্রিনের বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই ইয়াসমিনকে চিনতেন। স্কুলের মায়েরা তাকে সম্মান করতেন, কারণ তিনি ছিলেন শিক্ষিত, মার্জিত, সাহায্যপ্রবণ। বাঙালি নারীদের মাঝে তিনি ছিলেন এক আলোর মতো—নীরবে হাসতেন, নীরবে সহ্য করতেন। সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের জীবনের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন।
২০২২ সালের ২৪ মার্চ, বৃহস্পতিবার। সকালটা ছিল মেঘলা। ইয়াসমিন প্রতিদিনের মতো দুই ছেলেকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফেরেন। এক কাপ চা বানান। হয়তো কিছু রান্নাও শুরু করেন। কিন্তু সেই বিকেল আর এল না।
বাচ্চারা জানত, বিকেলে মা আসবে নিতে। কিন্তু বিকেলটা এল, মা এল না। স্কুল থেকে যখন ইয়াসমিন বাচ্চাদের আনতে গেলেন না, শিক্ষকরা অবাক হন। কারণ এমন আগে কখনো হয়নি। মোবাইলে একের পর এক ফোন, কোন সাড়া নেই। শেষমেশ স্কুলের শিশু সুরক্ষা কর্মকর্তা দুই শিশুকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে যান। দরজায় কড়া নাড়েন, ডাকাডাকি করেন, ভিতর থেকে মোবাইল ফোনের রিং শোনা যায়, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তিনি পুলিশে কল করেন। পুলিশ আসে। দরজা ভাঙে।
দরজা ভেঙে যখন ভিতরে প্রবেশ করা হয়, তখন ফ্লোরে পড়ে থাকা ইয়াসমিনের নিথর শরীরের পাশে ছিল শুধুই রক্ত। একটানা ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তার দেহ। তার গলায় ছিল না তার চিরচেনা সেই সোনার চেইন, যা তার মা তাকে দিয়েছিলেন। ব্যাগে ছিল না পার্স, ছিল না এটিএম কার্ড। ঘরের নীরবতা ছিল চিৎকারের চেয়েও বেশি তীব্র।
তদন্তে উঠে আসে কায়ুম মিয়ার নাম। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ, ফরেনসিক প্রমাণ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়—এ হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হত্যার দিন সকাল ৯:৫৫ মিনিটে কাইয়ুম হোমারটন থেকে বেরিয়ে যায়। তার কাছে একটি রাকস্যাক এবং একটি সবুজ-হলুদ ‘ব্যাগ ফর লাইফ’ ছিল।
সকাল ১০:৩০ মিনিটে সে গ্লোব রোডে পৌঁছে। এক প্রতিবেশী জানান, ইয়াসমিনের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি একটি লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছিল, যার চেহারা কাইয়ুমের সঙ্গে মিলে যায়।
দুপুর ২টায় ইয়াসমিন একটি প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা করে এবং আধাঘণ্টা পর বলেন, তিনি দন্তচিকিৎসকের কাছে যাবেন—স্কুল থেকে সন্তানদের নেওয়ার পর।
২:৩৫ মিনিটে তিনি ফোনে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন, যিনি পরে জানান, তখন ইয়াসমিনকে শুনতে হচ্ছিল যেন তিনি বাড়িতেই ছিলেন।
এরপরই কাইয়ুম ইয়াসমিনের ফ্ল্যাটে ঢুকে ভয়াবহ হামলা চালায়। এবং যাওয়ার সময় দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেয়।
পুলিশ কাইয়ুম মিয়াকে প্লাস্টোর এক বন্ধুর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। তার কাপড়ে ইয়াসমিনের রক্ত, পকেটে ইয়াসমিনের ব্যাঙ্ক কার্ড পাওয়া যায়। তদন্তে দেখা যায়, ঘটনার পরপরই ইয়াসমিনের ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে ৮০০ পাউন্ড তুলে নেয় কাইয়ুম। এছাড়া স্ত্রীর গয়না বন্ধক দিয়ে ২০০ পাউন্ড নেয়।
হোমারটনে কাইয়ুমের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ইয়াসমিনের রক্তযুক্ত একটি স্নিকারস এবং ইয়াসমিনের ফ্ল্যাট থেকে চুরি হওয়া একটি জিনিস উদ্ধার করে।
মেট পুলিশের স্পেশালিস্ট ক্রাইম কমান্ডের ডিটেকটিভ চিফ ইনস্পেক্টর ল্যারি স্মিথ বলেন, “ইয়াসমিন ছিলেন এক তরুণী মা, যিনি তার পুরনো সম্পর্ক থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রাখতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কাইয়ুম তার সেই সুযোগ কেড়ে নিয়েছে হিংস্রভাবে। সে তাকে নিজ বাড়িতে আক্রমণ করে, যেখানে ইয়াসমিন কোনো রকম আত্মরক্ষা করতেও পারেননি।”
আদালতে কাইয়ুম তার দোষ স্বীকার করে। ২০০০ সালের ১৭ মে। ওল্ড বেইলি আদালতে ১২ সদস্যের জুরি সর্বসম্মতভাবে ৪১ বছর বয়সী কাইয়ুম মিয়াকে ইয়াসমিন বেগমকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। ৯ জুন বিচারক রায় দেন—যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, কমপক্ষে ৩৩ বছর কাইয়ুমকে কারাগারে কাটাতে হবে।
বিচারক বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং অর্থলোভী। কাইয়ুম মিয়া অতীতে বারবার ইয়াসমিনের কাছ থেকে টাকা চুরি করেছেন, মাদক কেনার জন্য। এবার তিনি তার জীবনটাই কেড়ে নিলেন।”
রায় ঘোষণার সময় কোর্টরুমে কাঁদছিল ইয়াসমিনের দুই বাচ্চা। তারা এখন অনাথ। তারা বুঝে গেছে তাদের মা আর ফিরবে না। কিন্তু তারা বুঝবে কি, কীভাবে একজন বাবা, যাকে তারা ‘আব্বু’ বলে ডাকত, সেই মানুষটিই তাদের জীবনের আলো নিভিয়ে দিল? কমিউনিটি শোকাহত। অনেকে বলছে, “আমরা কখনো ভাবিনি কাইয়ুম এতটা নির্মম হতে পারে।” কেউ বলছে, “ইয়াসমিনের মতো মানুষ হারিয়ে গেল, আর আমরা কিছুই করতে পারলাম না।”
ইয়াসমিনের ভাই আতিক জামান বলেন, “আজ এক দানবকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো—হত্যা, জালিয়াতি এবং চুরির জন্য। এমন এক দানব, যে আর কখনও সমাজে মুক্তভাবে চলার সুযোগ পাওয়া উচিত নয়। সে আমাদের বোনকে শুধুমাত্র অর্থলাভের জন্য খুন করেছে।”
স্থানীয় একটি স্কুল ইয়াসমিনের নামে স্মরণ অনুষ্ঠান করে। স্কুলের বাচ্চারা কবিতা পড়ে, শিক্ষকরা চোখ মুছেন। কেউ জানে না—এই দুই শিশুর ভবিষ্যৎ কী হবে। মা নেই, বাবা কারাগারে। তারা এখন খালার কাছে থাকে।
বেথনাল গ্রিনের আকাশ যেমন ছিল, তেমনই আছে। গ্লোব রোডের বাতি যেমন জ্বলে, তেমনি জ্বলে। কিন্তু একটা জানালার পর্দা আর সরে না।