বরফঢাকা বরফের দেশে সকাল নামে এক কাপ গরম কফির সঙ্গে। কোনো পার্কের বেঞ্চে, অফিসের পথে, অথবা তুষারে মোড়া কোনো শহরতলির বাসস্টপে—হাতে থাকা কফির কাপ যেন কানাডিয়ানদের এক অলিখিত সঙ্গী। আর সেই কাপে যদি লেখা থাকে “Tim Hortons”, তাহলে গল্পটা শুধু গন্ধে আর স্বাদে সীমাবদ্ধ থাকে না, এক অদ্ভুত আবেগ, আর দেশপ্রেম জেগে ওঠে।
কানাডায় কফির আগমন ইউরোপিয়ান বসতি স্থাপনের সময় থেকেই, তবে ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কফি সত্যিকার অর্থে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ততদিনে নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে বসতি, আর মানুষ খুঁজছে এক গরম, তীব্র স্বাদের জাগরণ।
প্রথমদিকে কফি ছিল অভিজাত শ্রেণির পানীয়। পরবর্তীতে রেলওয়ে, খনি, মিল-ফ্যাক্টরি, আর রাতের প্রহরীরা একে তাদের পছন্দের পানীয় করে নেয়। সেখান থেকে কফি হয়ে ওঠে ‘working class drink’—মেহনতি মানুষদের পানীয়।
কিন্তু এই দেশীয় কফি-সংস্কৃতির চূড়ান্ত রূপ নিল তখন, যখন এক হকি খেলোয়াড়ের হাত ধরে জন্ম নিল “Tim Hortons” নামের এক প্রতিষ্ঠান। এক পেশাদার খেলোয়াড় কীভাবে কফির ইতিহাসে এমন ছাপ ফেললেন, এবার সেটা বলছি।
মাইলস গিলবার্ট (টিম) হর্টন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ১২ জানুয়ারি, ক্যালগারি শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, Bow River নদীর তীরে অবস্থিত কো-চ্রেন (Cochrane) নামে একটি মনোরম ছোট শহরে।
তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান আইস হকি খেলোয়াড়। ন্যাশনাল হকি লীগ (NHL)-এর বিখ্যাত দল ‘Toronto Maple Leafs’-এর হয়ে দীর্ঘ ১৮ বছর খেলেছেন। শক্তিশালী, স্থির ও নির্ভরযোগ্য ডিফেন্সম্যান হিসেবে তিনি দলের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন।
কিন্তু টিম হর্টনের জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য ও মিষ্টি মোড়টা এসেছে তখন, যখন তিনি ভাবলেন, “খেলা তো খেললাম অনেক, এবার যদি কফি বানিয়ে মানুষের মন জিতে নেই?”
১৯৬৪ সালে, হ্যামিলটন শহরে টিম হর্টন এবং তার সঙ্গী রন জয়স মিলে চালু করেন একটি ছোট কফি ও ডোনাট দোকান। দোকানের নাম হয় “Tim Horton’s Donuts”। তখন তারা কল্পনাও করেননি, এই ছোট্ট দোকান একদিন হয়ে উঠবে কানাডার আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
শুরুতে দোকানটি স্রেফ ডোনাট আর সাধারণ ব্ল্যাক কফির জন্য পরিচিত ছিল। “Always Fresh” স্লোগান আর সাশ্রয়ী দামে ভালো মানের কফি খুব দ্রুত সাধারণ মানুষের মন জয় করে নেয়। কফির সঙ্গে সঙ্গে ডোনাটের রয়েছে নানা রকমভেদ। আর পরবর্তীতে স্যান্ডউইচ, স্যুপ, চা—সব মিলিয়ে এটি হয়ে ওঠে এক অবিচ্ছেদ্য সকাল কিংবা বিরতির ঠিকানা।
১৯৭৪ সালে, মাত্র ৪৪ বছর বয়সে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় টিম হর্টনের মৃত্যু হয়। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ব্যবসায়িক চিন্তা, মানবিকতা এবং জাতীয় স্বপ্ন একে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার মৃত্যুর পর রন জয়স পুরো কোম্পানির মালিকানা গ্রহণ করেন এবং বিপুলভাবে একে সম্প্রসারণ করতে থাকেন।
আজকের দিনেও, যেকোনো টিম হর্টনসের কাপের নিচে আপনি খুঁজে পাবেন এক কানাডীয় আবেগ—যা শুধু কফির স্বাদের জন্য নয়, বরং এক মানুষ, এক গল্প, এক চেতনার জন্য।
কানাডায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত কফি খান। তার মধ্যে বিশাল অংশ ‘টিমস’—এই প্রিয় ডাকনামে ডাকে টিম হর্টনসকে।
এর জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ: (১) সহজ প্রাপ্যতা। শহর হোক বা গ্রাম, প্রতিটি কানাডিয়ানের ১৫ মিনিটের দূরত্বে একটা টিম হর্টনস থাকবেই। (২) সাশ্রয়ী মূল্য: অন্যান্য কফি চেইনের তুলনায় টিম হর্টনস কফি অনেকটাই সস্তা এবং বড় সাইজের।
সর্বশেষ (২০২৫ সাল নাগাদ) তথ্য অনুযায়ী টিম হর্টনসের শাখা সংখ্যা: ৫,৫০০-রও বেশি, যার মধ্যে ৪০০০-এরও বেশি কানাডায়। প্রায় ১ লক্ষের মতো লোক টিম হর্টনসে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কর্মরত। প্রচুর বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা টিম হর্টনসে কর্মরত রয়েছেন।
কানাডায় বাংলাদেশি মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি টিম হর্টনস রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইকবাল রুশদের মালিকানাধীন প্রায় দেড় ডজন টিম হর্টনস টরন্টোতে ও মোহাম্মদ আলম শানুর মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি টিম হর্টনস আছে মনট্রিয়লে।
টিম হর্টনস এখন কেবল কানাডা নয়; ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, ফিলিপাইনস সহ বেশ কিছু দেশে টিম হর্টনস-এর শাখা রয়েছে।
মজার তথ্য: টিম হর্টনসের অনন্য আবিষ্কার হলো— ”double-double”। কানাডায় কেউ যদি বলে “Give me a double-double”, সেটার মানে হচ্ছে দুই চামচ চিনি ও দুইটি ক্রিম দিয়ে এক কাপ কফি। আরেকটি— ”টিমবিটস”। ছোট ছোট বল আকৃতির টিমবিটস হচ্ছে এক কামড়ের ছোট বল আকারের ডোনাট।
প্রতিদিন টিম হর্টনসে তৈরি হয় কত গল্প, কত প্রেম! প্রথম দেখা, প্রথম পরিচয়, প্রথম আলাপ! ২০০৪ সালে এমনি এক ক্যানাডিয়ান দম্পতি তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করেছিলেন টিম হর্টনসে! কারণ সেখানেই তাদের প্রথম দেখা, প্রথম কফি, আর প্রথম প্রেম।
টিম হর্টনস কেবল একটি কফি দোকানের নাম নয়, এটি কানাডার চেতনা। এক হকি খেলোয়াড়ের কল্পনা, কানাডীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন, আর লক্ষ মানুষের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এটি কানাডার প্রতিটি গল্পের অংশ—চাকরির প্রথম দিনের, প্রেমে পড়ার মুহূর্তের, অথবা স্রেফ একা কাটানো দুপুরের।
পরের বার টিম হর্টনের কাপ হাতে নিয়ে যদি দাঁড়িয়ে থাকেন কোনো তুষারময় প্রান্তরে—মনে রাখবেন, এটি শুধু কফি নয়, এটি একটি কানাডীয় গল্প। যার প্রতিটি চুমুকে আছে দেশপ্রেম। কফির উষ্ণতা আর ঘ্রাণে আপনার মনের গভীর থেকে হয়তো নিজেই বলে উঠবেন—”এ দেশটি বরফে ঢাকা, কিন্তু এখানকার মানুষের হৃদয় গরম কফির মতোই উষ্ণ।”