সম্পাদকের পাতা

সিলেটের ‘কড়ই চা’!

নজরুল মিন্টো

বাড়ির বারান্দায় বন্ধু ডা. বিশ্ব পালের সাথে কড়ই দিয়ে গুড়ের চা উপভোগ করছি।

জীবনে আপনি হয়তো বহু ধরনের চা খেয়েছেন—দার্জিলিংয়ের সূক্ষ্ম পাতার সুবাসিত চা, শ্রীমঙ্গলের সাত রঙের রহস্যময়তা, কিংবা পাঁচতারকা রেস্টুরেন্টের বিলাসবহুল চা। কিন্তু ‘কড়ই চা’য়ের স্বাদ নিয়েছেন কি কখনও? আসুন, এ বিশেষ স্বাদের চায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

এ বিশেষ স্বাদের চায়ের দেখা মেলে না শহুরে কাঁচে বাঁধা ক্যাফেতে। তবে এক চুমুকেই মনে হবে—আপনি যেন ফিরে গেছেন গ্রাম বাংলার কোনো এক মাটির উঠোনে। আর এ চায়ের কাপে চুমুক দিতে হলে আপনাকে আসতে হবে ফেঞ্চুগঞ্জের কচুয়াবহর পয়েন্টের পালবাড়ি বাজারে। যেখানে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ের ভেতর লুকিয়ে আছে স্মৃতির স্বাদ, আর মাটির ঘ্রাণ।

গ্রাম বাংলায় আগের দিনে মাটির উনুনের পাশে বসে গরম গরম চালভাজা দিয়ে, গুড় দিয়ে তৈরি যে চা পরিবেশন করা হতো সেটা হচ্ছে ‘কড়ই চা’। চায়ের কাপে তখন ছিল না টি-ব্যাগ, মেশানো হতো না মিল্ক বা ক্রিম। খুবই সাধারণ একটি প্রস্তুতি। তবে স্বাদে ও ঘ্রাণে ছিল অনন্য।

কড়ই (চালভাজা)—বাংলার এক বিলুপ্তপ্রায় খাদ্যপ্রস্তুতির নাম। এটি মূলত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এক ধরনের ভাজা চাল, যা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন নামে পরিচিত হতে পারে, তবে সিলেট এলাকায় এটা কড়ই নামেই পরিচিত। এটি একসময় ছিল বাংলার প্রতিটি ঘরে-ঘরে রোজকার খাদ্যাভ্যাসের অংশ।

একদিকে কড়ই ছিল শিশুদের প্রিয় খাবার। অন্যদিকে বড়রা সকালে বা বিকালে, মাঠে-ঘাটে কাজ করার ফাঁকে, কিংবা কোনো আড্ডায় সহজলভ্য ও হালকা নাস্তা হিসেবে কড়ই খেতেন। অনেকে দীর্ঘ ভ্রমনে শুকনো খাবার হিসেবে কড়ই সাথে রাখতেন। অসুখ-বিসুখ হলে কড়ইয়ের সাথে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ ও সরিষার তেল মাখিয়ে খেতে খুব সুস্বাদু লাগে। বৃষ্টিভেজা দিনে কিংবা শীতের সন্ধ্যায় কড়ই দিয়ে চা পান করা নিরাভরণ এক আনন্দ বলা চলে!

আজকের দিনে শহুরে সমাজে সেই ‘কড়ই’ হারিয়ে গেছে। যারা গ্রামে বড় হয়েছেন তাদের কাছে কড়ই এখন স্মৃতির অংশ। দাদা-দাদী বা নানা-নানীর মুখে শোনা ছোটবেলার গল্পে ঠাঁই পাওয়া এক নস্টালজিক খাবার।

আপনি যতই আধুনিক হন, স্মার্টফোনের স্ক্রলে যতই দিন কাটুক, এক কাপ ‘কড়ই চা’ আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে গ্রাম বাংলার সেই হারিয়ে যাওয়া দিনে। চা তো জীবনে অনেক পান করেছেন, এবার একবার অন্তত শেকড়ের স্বাদ নিন! (কোনো রেস্তোরায় বা ক্যাফেতে পাওয়া না গেলে ঘরে তৈরি করুন।) আমি নিশ্চিত ‘কড়ই চা’ পান করে আপনি অন্যরকম একটি অনুভুতি পাবেন।

বি. দ্র: আমার মেয়েকে ‘কড়ই’ কি জিনিষ বুঝাতে গিয়ে কোনো অভিধানে এর ইংরেজি খুঁজে পাচ্ছি না। যা পাওয়া গেছে তা হলো- Puffed Fried Rice কিন্তু সেটা হচ্ছে মুড়ি। আবার Flattened Rice বলতে বুঝায় চিড়াকে। Toasted Rice Bits / Crisped Rice Snacks বললেও কড়ই-এর সে মচমচে ভাবটা আসেনা। তবে আমি মনে করি, নতুন জেনারেশনকে স্বনাম রেখে ব্যাখ্যা দিলে তারা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিতে পারবে। অর্থাৎ Koroi (fried rice crumbs) – a traditional Sylheti delicacy।


Back to top button

দয়া করে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের অনুমতি দিন

দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিজ্ঞাপন ব্লকার ব্যবহার করছেন। আমরা বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করি ওয়েবসাইটের ফান্ডের জন্য