সম্পাদকের পাতা

অষ্ট্রেলিয়ার কনস্পিকুয়াস ক্লিফের কষ্টগাথা

নজরুল মিন্টো

শাহিদুল হাসান স্বপন ও সাবরিনা আহমেদ পাপড়ি

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিশাল বিস্তৃত প্রান্তরে, যেখানে ঝাউবন মিশে গেছে পাহাড়ের ছায়ায়, আর নীল-সবুজ জলের আকাশ যেন মাটিতে নেমে এসেছে, সেখানে এক সৈকত আছে—নাম তার Conspicuous Cliff। একদিকে সমুদ্রের বিরামহীন ছন্দ, অন্যদিকে পাথরের বুক চিরে উঠে যাওয়া মৌনতা। এই নিস্তব্ধতাই যেন মানুষকে ডেকে আনে নির্জন এক আরামে—যেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরের কোলাহল থেকে কেউ কেউ ছুটি কাটাতে আসে।

ঠিক এমনই এক দিনে, ২০২৪ সালের ক্রিসমাসের পরদিন, পার্থ শহর থেকে দুই কন্যা আর মা-বাবা মিলে এসেছিলেন কিছু নিরিবিলি সময় কাটাতে। তারা জানত না, কিছুক্ষণ পরেই এই নীল সমুদ্র সাদা ঢেউয়ের আবরণে ঢেকে দেবে দু’টি প্রাণ—যাঁরা ছিলেন শুধু বাবা-মা নন, ছিলেন শিক্ষক, গবেষক, সমাজসেবী, এবং এক আদর্শ প্রবাসী বাংলাদেশি দম্পতি।

শাহিদুল হাসান স্বপন, বয়স ৪৪। পার্থের কার্টিন ইউনিভার্সিটির নগর পরিকল্পনা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। বাংলাদেশে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে চলে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সঙ্গে এসেছিলেন স্ত্রী সাবরিনা আহমেদ পাপড়ি, বয়স ৪০। তাঁরও পেশাগত পথটা একই রকম—নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনার ছাত্রী, জীবনসঙ্গী, সহযাত্রী। এই দম্পতির পরিচয় শুধু সফল একাডেমিক ক্যারিয়ারে সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁরা ছিলেন প্রবাসী বাঙালি সমাজে পরিচিত, শ্রদ্ধেয় মুখ।

তাঁদের ক্যাম্পাসে সবাই জানত—যখনই নতুন কোনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পার্থে আসতেন, স্বপন-সাবরিনার ঘর হয়ে উঠত প্রথম আশ্রয়। তাঁরা শুধু থাকার জায়গা দিতেন না, দিতেন সাহস, দিকনির্দেশনা, ঘরের মতো পরিবেশ। উইকএন্ডে তাঁদের বাসায় জমে উঠত আড্ডা, খাওয়া দাওয়া, বইয়ের আলোচনা, গান-বাজনা—সেইখানে যে কেবল শিক্ষাবিদেরা থাকতেন তা নয়, বরং তরুণ ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে নবাগত পরিবার, সবাই হাজির থাকতেন।

দুই কন্যাসন্তান তাঁদের সংসারের প্রিয় সঙ্গী। পড়াশোনা, চাকরি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সব কিছুতেই তাঁরা ছিলেন আন্তরিক ও মিশুক। তাঁদের ঘরে থাকত একটি ছোট পিয়ানো, বইয়ের তাকভর্তি শিশুদের গল্পের বই, আর বারান্দায় কয়েকটা সবুজ টব।

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তাঁদের ভূমিকা ছিল নিরব কিন্তু প্রভাবশালী। শাহিদুল নিয়মিত অংশ নিতেন পার্থ বাংলাদেশ সোসাইটির সভায়। উৎসব, বইমেলা, ভাষাদিবস—সবখানেই তাঁদের উপস্থিতি ছিল অবধারিত। কন্যা সিয়ানা আর রাইসার সঙ্গে তাঁরা স্টল দিতেন, ছোটদের আবৃত্তি শেখাতেন, কখনো কখনো নাচের তালে তাল দিতেন বাঙালিয়ানায়।

তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল অনন্য। নিজেদের ফ্ল্যাটে গড়া ছিল এক ছোট্ট গ্রন্থাগার, যেখানে ছিল নগর পরিকল্পনার ক্লাসিক বই, বাংলাদেশের সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথের সংকলন আর তাদের মেয়ে সিয়ানা-রাইসার কার্টুন বই। দেয়ালে ছিল তাঁদের খুলনার সময়কার একটা ছবির কোলাজ—ছোটখাটো এক স্মৃতিচিহ্ন, যা হারিয়ে যাওয়া সময়কে ধরে রেখেছিল।

ক্রিসমাসের সেই সকালে তাঁরা পার্থ থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছিলেন সমুদ্র দেখতে। সংক্ষিপ্ত ছুটি, কেবল মেয়েদের আনন্দ দিতে তারা বের হন। কে জানত, তাঁদের সেই যাত্রা হবে শেষবারের মতো?

ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সেই উপকূল—Conspicuous Cliff—যেখানে সাদা বালি আর সবুজ ঢেউ মিশে যায় এক কবিতার মতো নিস্তব্ধতায়, সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্বপন-পাপড়ি ও তাঁদের দুই কন্যা। গাড়ির পেছনে রাখা ছিল একটা ছোট কুলার, মেয়েদের সাঁতারের পোশাক, কিছু ফল আর একটা জলরঙের খাতা—যাতে রাইসা কখনও সৈকতের পাখির ছবি আঁকে।

সিয়ানা তখন জলের ধারে দাঁড়িয়ে, ছোট পায়ের ছাপ রেখে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ স্রোতের ধাক্কায় সে পড়ে যায়। ডুবে যেতে থাকে প্রবল স্রোতের টানে। সেই Rip Current, যা দেখায় না তীব্রতা, বোঝায় না ভয় কিন্তু হঠাৎ করে কেড়ে নেয় পায়ের নিচের বালি। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন শাহিদুল আর পাপড়ি। তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন জলে। মেয়ে যেন ভেসে না যায়, যেন কোলের এই টুকরোটা হারিয়ে না যায় ঢেউয়ের ফাঁকে।

স্বপন আগে পৌঁছান। সিয়ানার হাত ধরেন। পেছনে সাবরিনা। মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে উপরের দিকে ঠেলেন। সিয়ানা ফিরতে থাকে… ফিরে আসে তীরে। তবে যাঁরা তাঁকে ঠেলে দিয়েছিলেন ওপরে, তাঁরাই আর ওপরে ফিরতে পারেন না। জল তাঁদের টেনে নিয়ে যায়।

ডাক পড়ে পুলিশের, মানুষ ছুটে আসে— দুপুর ২:৪০। কেউ ফোন করে জরুরি বিভাগে—”তিনজন জলে আটকে গেছে!” পরিবারের এক বন্ধু ছুটে যান সাহায্যে। সাহসের সেই মুহূর্তে তিনিও ঝাঁপ দেন ঢেউয়ের পেটে। পরে স্থানীয়রা এবং জরুরি বাহিনী একত্রে তাঁদের পানি থেকে তোলে। CPR দেওয়া হয়। কিন্তু জীবন তখনো জলে পড়ে থাকে। শাহিদুল আর পাপড়িকে আর ফেরা যায় না। সেই বন্ধু কিছুটা সৌভাগ্যবান, হাসপাতালে নেওয়ার পরে তিনি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হন।

পার্থ শহরে ছড়িয়ে পড়ে মর্মান্তিক এ খবর। বাংলাদেশি কমিউনিটি শোকে স্তব্ধ। কমিউনিটির মানুষজন তখন ভিড় করে হাসপাতালের বাইরে। কেউ তাদের ছবি দেখে অশ্রুসজল হয়ে পড়ে, কেউ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে, চোখে জলের রেখা নিয়ে।

Conspicuous Cliff, যে অঞ্চলটির নামই যেন বলে দেয়, এটা গোপন নয়, এটা স্পষ্ট। কিন্তু তবু, সেখানে ছিল অদৃশ্য স্রোতের ফাঁদ। ক্লিফের নিচে পড়ে থাকা সেই জলের ঢেউ তখনও থেমে যায়নি। পাথরে বসে থাকা গাঙচিল যেন তাকিয়ে ছিল বিস্ময়ে—এই তো এখনো তারা হাসছিল, আর এখন কোথাও নেই।

স্থানীয় কাউন্সিল জানায়, এই এলাকায় কোন সতর্ক বার্তা দেওয়া ছিল না সেই সময়।

দম্পতির মরদেহ দুটি স্থানীয় হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরে সরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাঁদের সন্তানরা তখন নিঃশব্দে চেয়ে আছে—যে মানুষগুলো সবসময় পাশে থাকতেন, এখন তাঁরা কাঠের বাক্সে শুয়ে।

পার্থ শহরের মসজিদ আল আমিনে যখন তাঁদের জানাজার প্রস্তুতি চলছিল, তখন চারপাশে জমে উঠছিল মানুষ—শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারতীয়, পাকিস্তানি, আরব, এমনকি অস্ট্রেলিয়ান বন্ধু-সহকর্মীরাও। সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ছিল দুজন—একসঙ্গে শোয়ানো, যেন জীবনের মতো মৃত্যুতেও তাঁরা এক।

একটি ছোট মেয়ের জীবন বাঁচাতে গিয়ে মা-বাবা যেভাবে প্রাণ দিয়েছিলেন, তা কোনো জল ঢেকে রাখতে পারবে না। কোনো ঢেউ ধুয়ে ফেলতে পারবে না এই আত্মত্যাগ।

স্মরণ সভায় Curtin University-র সহ-শিক্ষক ড. অ্যানাবেল জেমস বলেছিলেন: “Professor Sapon was not only an academic. He was a bridge—for cultures, for newcomers, and for kindness.”

সাবরিনার এক প্রিয় বন্ধু ড. ফিওনা গার্সিয়া বলেন: “She was the warmest voice in our meetings. She wouldn’t speak first, but when she did—everyone listened.”

কমিউনিটির তরুণরা একটি বিশেষ প্রোগ্রাম হাতে নেয়: ‘Sapon-Papri Memorial Scholarship’, Curtin University-তে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। যেন তাঁদের শিক্ষা ও ত্যাগ স্মরণে থাকে প্রতিটি প্রজন্মে।


Back to top button