সম্পাদকের পাতা

চেরি ফুলের দেশে হারিয়ে গেলেন শামীমা

নজরুল মিন্টো

শামিমা আখতার

জাপান—প্রাচ্য আর প্রগতির মিশেলে গঠিত এক দেশ। যেখানে প্রাচীন টেম্পলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে আধুনিক প্রযুক্তির সুউচ্চ টাওয়ার। যেখানে ট্রেন চলে নির্ভুল সময়ে, আর মানুষের মুখে শিষ্টাচারের অনুবাদ হয়ে থাকে নীরবতা। বসন্ত এলেই চেরি ফুলে ভরে ওঠে শহরের প্রতিটি গলি, স্কুল প্রাঙ্গণ, পার্কের বেঞ্চ। এই মুহূর্তগুলো জাপানিজ সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ, এক মোহময় শান্তি।

টোকিওর উত্তরে যে প্রদেশটি অবস্থিত তার নাম- সাইতামা। সুন্দর সাজানো গোছানো বসতি, নিরিবিলি রাস্তা আর শান্তিময় সকাল নিয়ে এক ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য। এখানে বসবাস করেন অনেক বিদেশি নাগরিক, যাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের উপস্থিতিও ক্রমাগত বাড়ছে।

জাপানে বাংলাদেশি প্রবাসীদের একটি শক্তিশালী কমিউনিটি রয়েছে—প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি। অনেকে এসেছেন শিক্ষার টানে, কেউ বা শ্রমিক হিসেবে, কেউ ব্যবসা বা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে। টোকিও, ইয়োকোহামা, ওসাকা, কাওয়াসাকি, নাগোয়ায় যেমন ছাত্র ও গবেষকরা রয়েছেন, তেমনি কারখানায়, রেস্টুরেন্টে, নির্মাণসাইটে কর্মরত সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যাও কম নয়।

এই প্রবাসী সমাজে ছিলেন শামিমা আখতার। দেশের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী। সেখান থেকেই উচ্চশিক্ষার অন্বেষণে পাড়ি জমান জাপানে। ২০১১ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করে তিনি যোগ দেন টোকিওর ন্যাশনাল সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড মেডিসিন-এর এপিডেমিওলজি বিভাগে। পরে সেই বিভাগেই উঠে আসেন বিভাগীয় প্রধানের পদে।

শুধু কর্মজীবন নয়, গবেষণায়ও তার নাম ছড়িয়ে পড়ে জাপান ও আন্তর্জাতিক মহলে। বিয়ের পর স্বামী বিএম শাহাদত হোসেনের সঙ্গে বসবাস করতেন সাইতামার কোশিগায়া শহরে। কিন্তু এই সাফল্য, এই আলোকিত পথ—সবকিছুর মাঝেই জমে ছিল কিছু অদৃশ্য ছায়া।

শাহাদত হোসেন (৫১) ছিলেন বেকার। একসময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও দীর্ঘদিন কর্মহীন থেকে মানসিকভাবে ভারসাম্য হারান বলেই জানান স্থানীয় বাংলাদেশিরা। এ দম্পতির সন্তানাদি ছিল না। এই বিষণ্ণতা, আত্মসম্মানের টানাপড়েন এবং স্ত্রী’র সাফল্য—সম্ভবত একসঙ্গে মিলে জন্ম দিয়েছিল এক অবর্ণনীয় অসন্তোষ।

২০১৯ সালের ৪ মার্চ। সকাল নেমেছিল নিঃশব্দে। কিন্তু সেই সকালে সাইতামার সেই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ঘটে যায় এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড। শাহাদত ধারালো ছুরি দিয়ে শামিমাকে হত্যা করেন। এরপর আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দেন চলন্ত ট্রেন লাইনের সামনে। কিন্তু মৃত্যু তার কাছে ধরা দেয়নি। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় টোকিওর একটি হাসপাতালে।

শামিমার ভাই ২ মার্চ জাপানে নিখোঁজ সংক্রান্ত অভিযোগ জানিয়ে ছিলেন। পুলিশ তল্লাশি শুরু করে এবং ৮ মার্চ সন্ধ্যায় শামিমার নিথর দেহ উদ্ধার করে তাদের বাসা থেকে।

এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহাদত পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করেন। ঘটনাটি জানাজানি হতেই পুরো প্রবাসী কমিউনিটিতে নেমে আসে শোকের ছায়া, আতঙ্ক আর লজ্জা।

টোকিওর এক বাঙালি গবেষক বললেন—“শামিমা আপা আমাদের অনুপ্রেরণা ছিলেন। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, নারী হয়েও প্রবাসে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। অথচ সেই মানুষটি এমন নির্মমভাবে শেষ হয়ে যাবে—এটা কল্পনাও করিনি।”

স্থানীয় বাংলাদেশিরা জানান, শামিমা ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, শান্ত, এবং উচ্চশিক্ষিত। কর্মক্ষেত্রে তার সুনাম ছিল বিস্তর। অথচ, এমন এক নারীর জীবন এত নৃশংসভাবে থেমে যাবে—এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না কেউ।

প্রবাসে নারী জীবনের সংগ্রাম কখনো কখনো দ্বিগুণ কঠিন। বাইরে পেশাগত চাপ, ভেতরে পারিবারিক অশান্তি—এই দ্বৈত যন্ত্রণায় অনেকেই নিঃশব্দে পুড়ে যান। শামিমা ছিলেন সেই নিঃশব্দ আগুনের এক করুণ সাক্ষ্য।

ঘটনার দিন কয়েক আগে এক আত্মীয়ের কাছে শামিমা জানিয়েছিলেন মানসিক অস্থিরতা আর দাম্পত্য নির্যাতনের কথা। কিন্তু এই অভিযোগ কোনো আইনি সাহায্যে রূপ নেয়নি, কোনো বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মীও তাকে বাঁচাতে পারেনি।

শাহাদতের পেছনের কাহিনি

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএম শাহাদত হোসেনের বাড়ি বরিশাল অঞ্চলে। যুবক বয়সে চাকরির সুবাদে ঢাকা ছিলেন। পরবর্তীতে প্রবাসী জীবন বেছে নিয়ে জাপানে আসেন। শুরুতে বিভিন্ন খণ্ডকালীন চাকরি করলেও পরে কোনো স্থায়ী আয়সূত্র না থাকায় তার মধ্যে হতাশা, বিষণ্ণতা এবং মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

প্রতিবেশীরা জানান, তারা দম্পতিকে খুব কমই বাইরে দেখতেন। কখনো কোনো উচ্চবাচ্য শোনেননি, অথচ এই নিস্তব্ধতাই যে ভিতরে আগুন পুষে রাখছিল—তা বুঝতে পারেননি কেউ।

এই ঘটনাটি জাপানের বাংলাদেশি কমিউনিটিকে একদম নাড়িয়ে দেয়। অনেকেই বলেন, এটি তাদের সম্মান ও ভাবমূর্তিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে।

জাপানের আকাশে যখন চেরি ফুল ঝরে পড়ে, তখন সেটা কেবল ঋতু পরিবর্তনের নয়—মনে হয় যেন কিছু কথা অপূর্ণ রয়ে গেল, কিছু গল্প অসমাপ্ত থেকে গেল। শামীমার গল্পও তেমনই—একটি অসমাপ্ত, অথচ স্মরণীয় অধ্যায়।


Back to top button