
বাহরাইন—আরব উপসাগরের এক শান্ত দ্বীপরাজ্য। রোদস্নাত আকাশ, বালুমাখা মাঠ, কাঁচের মতো ঝকঝকে রাস্তাঘাট আর আকাশচুম্বী ভবনের দেশ এটি। চারপাশে মরুর বিশালতা, কিন্তু তার বুক চিরে নির্মিত হয়েছে এক বিস্ময়কর নগরায়ন। রাজধানী মানামা থেকে মুহাররাক, রিফা থেকে সিত্রা—প্রতিটি শহর যেন শিল্পায়নের প্রতীক, তবে এর ভিতরেই লুকিয়ে আছে হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিকের কাহিনি।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অসংখ্য মানুষ এখানে এসেছে ভাগ্য বদলাতে। কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ গাড়িচালক, কেউ আবার রেস্টুরেন্টে কাজ করেন বা মুয়াজ্জিন-ইমামের দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশি কমিউনিটি বিশেষভাবে দৃশ্যমান মুহাররাক শহরে। এখানকার সিদা মসজিদ, বিন শাদ্দাহ মসজিদ কিংবা আল মাজরা’র পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট দোকান, হালাল রেস্টুরেন্ট আর মোবাইল সার্ভিস সেন্টারগুলোতে কাজ করেন বহু বাংলাদেশি। শুক্রবারে মসজিদে বাংলা হাদিস শোনা যায়, ঈদের সময় ময়দানে দেখা মেলে নিজস্ব সংস্কৃতির ছাপ। এক অদৃশ্য প্রবাসী গ্রাম যেন এখানে গড়ে উঠেছে।
২০১৮ সালের ৫ আগস্ট, রোদের আগে ভোরের আলোয় ঢেকে যাওয়া মুহাররাকের সিদা মসজিদ। মুয়াজ্জিন কামাল উদ্দিন আজানের ধ্বনি তুলেছিলেন যথারীতি, ফজরের নামাজও হয় শান্তিপূর্ণ। কিন্তু নামাজ শেষে, যখন মুসল্লিরা মসজিদ ত্যাগ করছিলেন, তখন মসজিদের এক কোণে জমা হচ্ছিল অন্ধকার এক ষড়যন্ত্র।
২০০৯ সালে কামাল উদ্দিন (৩৫) বাহরাইনে আসেন এবং মুহাররাক এলাকার সিদা মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করতেন। তার দেশের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ভিসা ও রেসিডেন্সি পারমিটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আদায় করতেন। এ কারণে ইমাম আবদুলজালিল হামুদ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন, যার ফলে কামাল উদ্দিনের চাকরি বাতিল হয় এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

সে রাতে কামাল পূর্বপরিকল্পিতভাবে একটি লোহার রড মসজিদের ভিতরে লুকিয়ে রাখেন। নামাজ শেষ হতেই তিনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। যখন ইমাম একা মসজিদের ভেতর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন পিছন থেকে কামাল রড দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকেন। ইমাম মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে মৃতদেহকে তিন টুকরো করে কামাল প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে ফেলেন এবং একটি স্যুটকেসে রেখে তার ঘনিষ্ঠ একজনকে (সহ অভিযুক্ত) ফোন করেন। সেই ভয়াল সকালটি যেন মুহাররাকের বুকে রক্তমাখা কালি দিয়ে লেখা হয়ে গেল।
কামাল যখন মৃতদেহ ফেলার জন্য আল মাজরা এলাকার একটি স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডের পাশে অবস্থান করছিলেন, তখন দুই স্থানীয় কর্মী তার আচরণে সন্দেহ করে পুলিশে খবর দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে গ্রেপ্তার করে। উদ্ধার হয় ইমামের খণ্ডিত দেহ।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে কামাল অপরাধ স্বীকার করেন। তিনি জানান, এটি ছিল তার ‘প্রতিশোধ’।
বাহরাইনের হাই ক্রিমিনাল কোর্ট মামলার শুনানিতে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই, সেই দণ্ড ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। সহঅভিযুক্তকে এক বছরের কারাদণ্ড ও সাজা শেষে দেশ থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়।
এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র। বাহরাইনের সংসদে এই নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়। সমাজে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক ও ক্ষোভ। “বাংলাদেশি” পরিচয় যেন এক অজানা ভয় হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয়দের চোখে।
বাংলাদেশি কমিউনিটি তখন লজ্জিত, স্তম্ভিত, আতঙ্কিত। অনেকে নিজেকে আড়াল করেন, কেউ কেউ কাজ হারান। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়—সব বাংলাদেশি ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে বারবার কূটনৈতিকভাবে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালানো হয়। বাহরাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম দপ্তর ও ওয়াকফের সাথে বারবার চিঠি, ফোন, ওয়েবিনার করে চেষ্টা করলেও প্রতিবারই একটি উত্তর আসে: “এই সিদ্ধান্ত উচ্চপর্যায়ের, পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই।”
২০২১ সালের মে মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বেশিরভাগ বাংলাদেশি ইমাম-মুয়াজ্জিনকে ধাপে ধাপে ফেরত পাঠানো হয়। শুধুমাত্র ওই বছরের মে মাসেই ২৫ জনকে ফেরত পাঠায় ওয়াকফ কর্তৃপক্ষ।
এই একটিমাত্র হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সঙ্গে বাহরাইনের শ্রমবাজারে সম্পর্ককে ছিন্ন করে দেয়। ইমাম-মুয়াজ্জিনদের উপর আস্থা হারায় বাহরাইন। এমনকি সাময়িকভাবে শ্রমিক নেওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য এক অপ্রত্যাশিত ধাক্কা ছিল।এই বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা হাজারো সৎ, পরিশ্রমী, প্রার্থনাকারী বাংলাদেশি মুসল্লিদের মাথা নিচু করে দেয়।
সেদিন মসজিদের দেয়ালে শুধু এক ইমামের রক্ত নয়, লেপ্টে গিয়েছিল একটি জাতির দুঃখ।