সম্পাদকের পাতা

সিঙ্গাপুরে প্রেমের বলি আহমেদ সেলিম

নজরুল মিন্টো

আহমেদ সেলিম

সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ চীন সাগরের কোলঘেঁষা এই দ্বীপনগরী যেন এক জীবন্ত জাদুঘর—যেখানে পশ্চিমা আকাশচুম্বী দালান দাঁড়িয়ে থাকে প্রাচ্য ঘ্রাণমাখা বৌদ্ধমন্দিরের পাশে। চারপাশে গাছগাছালিতে মোড়ানো পরিচ্ছন্ন রাস্তা, আকাশে সাদা মেঘের মতো উড়তে থাকা মেরিনা বে স্যান্ডসের গম্বুজ, আর নিচে বিচিত্র মানবজীবনের মিছিল।

বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে সিঙ্গাপুর শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নয়, গোটা বিশ্বের কাছে এক অনন্য মডেল। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা এই নগরীর প্রতিটি কোণায় আছে কর্মব্যস্ততা—ডিজিটাল স্ক্রিনে ভেসে থাকা শেয়ারবাজারের ওঠানামা, আর সিঙ্গল লাইন ট্রেনের মতো সুশৃঙ্খল নাগরিক জীবনের প্রবাহ। এখানে কেউ চিৎকার করে কথা বলে না, ট্রাফিক আইন ভাঙে না, আর ছুটির দিনেও শপিং মলগুলো থাকে জনারণ্য।

এই সিঙ্গাপুরেই ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হলো আহমেদ সেলিম নামে এক বাংলাদেশি যুবককে।

আহমেদ সেলিম, পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। ২০১২ সালে তার দেখা হয়েছিল ইন্দোনেশীয় গৃহকর্মী নুরহিদায়াতি ওয়ার্তোনো সুরাতার সঙ্গে। পরিচয় থেকে ভালোবাসা, আর ভালোবাসা থেকে একপ্রকার বাঁধন। ২০১৭ সালের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সেলিম একটি আংটি পরিয়ে দেন ইয়াতির হাতে। তাদের বিয়ের দিন ঠিক হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর।

কিন্তু প্রেমের নদীতে সবসময় নৌকা ভাসে না। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি, নুরহিদায়াতির জীবনে আসে অন্য এক পুরুষ—এক বাংলাদেশি প্লাম্বার। সেলিম টের পান, কিছু একটা বদলে যাচ্ছে এবং ইয়াতিও সত্যতা স্বীকার করে। সেলিম রাগে, বিষাদে, বেদনায় এক পর্যায়ে নিজেই নিজের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করেন। পরিবারকে বলেন পাত্রী খুঁজে দিতে। ঠিক হয় ফেব্রুয়ারিতে তার বিয়ে হবে বাংলাদেশে। কিন্তু হৃদয়ের অলিন্দে যিনি রয়ে যান, তিনি তো নুরহিদায়াতি।

এরই মধ্যে তাদের সম্পর্ক আবার জোড়া লেগে যায়। তারা দেখা করেন, কথা বলেন, এমনকি হোটেলে মিলিত হন। কিন্তু সম্পর্ক থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় বিশ্বাস। হঠাৎ কোনো এক রাতে, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে সেলিম তোয়ালে দিয়ে ইয়াতির মুখ চেপে ধরেন। পরে ছেড়ে দেন।

নুরহিদায়াতি ওয়ার্তোনো সুরাতার

ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে ইয়াতি জানান যে তিনি সেলিমকে ভালোবাসেন না, অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্ক করছেন। এরপর ৩০ ডিসেম্বর তারা আবার দেখা করেন সিঙ্গাপুরের গোল্ডেন ড্রাগন হোটেলে। সেদিন, এক মুহূর্তে, কথার পর কথার ভেতর, সেলিম তোয়ালে দিয়ে তার গলা চেপে ধরেন। এবার আর ছেড়ে দেন না যতক্ষণ না থেমে যায় ইয়াতির নিঃশ্বাস।

২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা চলে দীর্ঘদিন। আদালত ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। আপিল করা হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে—যা খারিজ হয়ে যায়। পরে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া হয়, সেটিও ব্যর্থ হয়।

আইনজীবী ইউজিন থুরাইসিংগাম এবং তার টিম যুক্তি দেন, সেলিম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। তার ছিল অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার—যার ফলে আচরণগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু আদালত বলেন, “সে জানত সে যা করছে তা ভুল, এবং সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়নি।”

ফাঁসির দিন সেলিমের সাথে ছিলেন একজন ইমাম। তার জন্য প্রার্থনা করা হয়। তারপর নিঃশব্দে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই ঘরে—যেখানে আলো থাকে না, শুধু থাকে ইতিহাসের শেষ প্রহর।

সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা সংখ্যায় প্রায় দেড় লাখ। নির্মাণ থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতা, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা সমাজের প্রান্তিক পরিসরে। তারা অনেক সময় বঞ্চিত হয় ন্যায্য বেতন, মানবিক পরিবেশ ও মানসিক সহায়তা থেকে।

আহমেদ সেলিমের ঘটনাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে একধরনের হতভম্ব নীরবতা নেমে আসে। কেউ মুখ খুলে কিছু বলেনি, কেউ প্রতিবাদ করেনি। তাদের অনেকেই বলেছে—“যা হওয়ার তাই হয়েছে। আইন অমান্য করলে শাস্তি হবেই।” কেউবা বলেছে—“মন তো মানুষেরই থাকে, কেউ মানতে পারে না ভালোবাসার প্রতারণা।” এভাবে এক প্রবাসীর মৃত্যুর গল্প হয়ে ওঠে আরেক প্রবাসীর দিনের শেষে গভীর নিঃশ্বাস।

সিঙ্গাপুরের সরকার মনে করে, মৃত্যুদণ্ডই দেশটিকে নিরাপদ করে তুলেছে। এখানকার আইন কঠোর, বিচারে বিলম্ব নেই, আর অপরাধ করলে শাস্তি নিশ্চিত। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, মৃত্যুদণ্ডের কোনো প্রমাণিত প্রতিরোধমূলক প্রভাব নেই।

স্থানীয় সংগঠন Transformative Justice Collective (TJC) সেলিমের মানসিক স্বাস্থ্য এবং বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে—“শুধুমাত্র সবচেয়ে গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করা হয়—যা ব্যক্তি বা সমাজের প্রতি মারাত্মক ক্ষতি সৃষ্টি করে।”

সেলিমের মৃত্যুর পর কেউ জানে না, তার দেহ কীভাবে মাটি পেয়েছে, প্রিয়জনেরা কী দেখেছে শেষবার? আহমেদ সেলিম নামের এক যুবকের গল্প হয়তো শেষ, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- কেন ভালোবাসা হারালে মানুষ এতো নিঃশেষ হয়ে যায়? ভালোবাসা কি হারায়?


Back to top button