সম্পাদকের পাতা

কানাডার ২০২৫ সালের নির্বাচন: একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু

নজরুল মিন্টো

শীতের প্রান্ত ছুঁয়ে, এক উজ্জ্বল বসন্তের ভোরে কানাডা আবারও তার গণতন্ত্রের সূর্য উন্মোচিত করল। ২০২৫ সালের ফেডারেল নির্বাচন ছিল কেবল আরেকটি নির্বাচন নয়, ছিল জাতীয়তাবাদী আবেগের পুনর্জাগরণ, আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয়, আর নেতৃত্বের রূপান্তরের এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। নির্বাচনের ফলাফল, পরবর্তী সরকার গঠন এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মিলিয়ে কানাডা এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করল, যার দায়িত্ব এখন মার্ক কার্নির নেতৃত্বে গঠিত লিবারেল পার্টির সংখ্যালঘু সরকারের হাতে।

প্রধান দুই দলের নেতাদের পরাজয়
পিয়েরে পয়লিয়েভ্রে, কনজারভেটিভ পার্টির নেতা, তাঁর দীর্ঘদিনের আসন কার্লেটন থেকে পরাজিত হয়েছেন। এই আসনে তিনি ২০০৪ সাল থেকে প্রতিনিধিত্ব করে আসছিলেন। এই পরাজয় কনজারভেটিভ পার্টির জন্য একটি বড় ধাক্কা। ​

জাগমিত সিং, এনডিপি নেতা, বার্নাবি সেন্ট্রাল আসনে পরাজিত হয়েছেন। এই পরাজয়ের পর তিনি দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হয়েও লিবারেল হাসছে বিজয়ের হাসি
লিবারেল পার্টি ১৬৮টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলেও, তাদের অবস্থান ছিল দৃঢ় এবং সম্মানজনক। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল ১৭২টি আসন। কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১৩৩টি আসন, ব্লক কিউবেকোয়া ২১টি আসন, এনডিপি মাত্র ৫টি আসন, গ্রিন পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র ৪টি আসন লাভ করে।

ফলাফল ইঙ্গিত দেয়, জনগণ পরিবর্তন চেয়েছিল, কিন্তু বিপ্লব নয়। তারা চেয়েছিল আরও স্থিতিশীল, আরও প্রতিরোধী এক কানাডা।

কেন লিবারেল দলকে আবারও বেছে নিলো জনগণ
২০২৫ সালের নির্বাচনে কানাডার জনগণ লিবারেল পার্টিকে পুনরায় নির্বাচিত করেছে মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে: প্রথমত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্ভাব্য অশান্ত সম্পর্কের আশঙ্কা কানাডিয়ানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলে। মার্ক কার্নির নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি ট্রাম্পের হুমকির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়, যা অনেক ভোটারকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করে।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়েও মধ্যবিত্ত এবং শ্রমজীবী মানুষের জন্য লিবারেল নীতিগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য। কর হ্রাস, ডেন্টাল কেয়ারের মতো সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ভোটারদের আস্থা অর্জন করে।

তৃতীয়ত, অভিবাসী ও বহুসাংস্কৃতিক সমাজের মধ্যে লিবারেল পার্টির অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভার এবং মন্ট্রিয়ালের মতো শহরগুলোতে, তাদের শক্তিশালী সমর্থন বজায় রাখে।

টরন্টোর বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো, যেখানে অভিবাসী সম্প্রদায়ের আস্থা ছিল স্থিতিশীল নেতৃত্বের পক্ষে। স্কারবোরো সাউথওয়েস্ট আসন থেকে লিবারেল পার্টির বিল ব্লেয়ার ২৬,৮৭১ ভোট পেয়ে বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন।

টরন্টোর বিচেস-ইষ্ট ইয়র্ক আসনে বিজয়ী হয়েছেন লিবারেল পার্টির সাবেক এমপি নেইট এরস্কিন-স্মিথ। তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ২৮,৯১৯ (৫৬.৫৮%)।

২০২৫ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ এশীয় এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই সম্প্রদায়গুলোর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে কানাডার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আরও বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে বলে আশা করা যায়।

এবারের নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক ৭ মিলিয়ন আগাম ভোট পড়েছে, যা কানাডার নির্বাচনী ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক।

সরকার গঠন: সংখ্যালঘু সরকারের দায়ভার
১৪ মার্চ, ২০২৫। মার্ক কার্নি কানাডার ৩০তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তাঁর নেতৃত্বে একটি ছোট অথচ কৌশলী মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।

কার্নি সরকার একটি সংখ্যালঘু সরকার। ফলে, টিকে থাকতে তাদের ব্লক কিউবেকোয়া এবং কখনো কখনো এনডিপির সমর্থন নিতে হবে। যদিও আনুষ্ঠানিক কোনো জোট হয়নি, তবে নির্দিষ্ট নীতিগত প্রশ্নে সমর্থন পাওয়ার আলোচনা চলতে পারে।

জাস্টিন ট্রুডোর বিদায়বেলা
কানাডার রাজনীতির গত এক দশকের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ জাস্টিন ট্রুডো, নির্বাচনের আগে লিবারেল পার্টি এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন। বিদায়ী ভাষণে তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি দেশ গড়েছি যা প্রতিটি মানুষের অধিকার উদযাপন করে। এখন সময় এসেছে নতুন নেতৃত্বের।” ট্রুডো কার্নির ওপর পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করে যান। তাঁর এই সৌজন্যপূর্ণ সরে দাঁড়ানো কানাডার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকেই আরও মহিমান্বিত করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্ক কার্নিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “মার্ক কার্নি হবেন এমন এক নেতা, যিনি গণতন্ত্রের মশাল উঁচিয়ে ধরবেন।” অপরদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য করার হাস্যকর প্রস্তাব পুনরায় তোলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “ভারত-কানাডা সম্পর্ক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে আরও এগিয়ে যাবে।”

বিজয়ীদের প্রতিশ্রুতি:
মার্ক কার্নি তাঁর বিজয়ী বক্তৃতায় বলেন: ১) যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমানো হবে। ২) পরিবেশ সুরক্ষায় কার্বন ট্যাক্স বজায় রাখা হবে। ৩) মধ্যবিত্তের জন্য কর হ্রাস করা হবে। ৪) ডেন্টাল কেয়ার চালু রাখা হবে। ৫) পাবলিক ব্রডকাস্টারকে অর্থায়ন বৃদ্ধি করা হবে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ:
লিবারেল পার্টির জন্য এবারের পথচলা কঠিন হবে। সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে তাদের রাজনৈতিক দক্ষতা ও কৌশলিক সমঝোতার পরিচয় দিতে হবে। মন্ত্রিসভায় তাৎক্ষণিক রদবদলের কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তন হতে পারে। যদি সমর্থন নড়বড়ে হয়, নতুন নির্বাচন বা সরকার পতনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

নতুন কাব্যের শুরু:
২০২৫ সালের নির্বাচন কানাডাকে আবার স্মরণ করিয়ে দিল — গণতন্ত্র কখনো সহজ রাস্তা নয়। কখনো তা প্রশ্ন করে, কখনো তা পরীক্ষা নেয়। কিন্তু প্রতিবারই জনগণের রায় নতুন সূর্যের কিরণ বয়ে আনে। মার্ক কার্নির নেতৃত্বে কানাডা এখন এক নতুন অভিযাত্রায় পা রাখল, যেখানে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ হাতে হাত ধরে পথ চলবে।


Back to top button