সম্পাদকের পাতা

বিশ্ব সিলেট সম্মেলন: টরন্টোতে এক খন্ড সিলেট

নজরুল মিন্টো

গ্র্যান্ড প্যালেসের উন্মুক্ত এলাকা হয়ে উঠেছিল একখন্ড সিলেট। বলছি গত ১ ও ২ সেপ্টেম্বর টরন্টোতে অনুষ্ঠিত ৪র্থ বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের কথা। মানুষ আর মানুষ। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত ছিল গোটা এলাকা। যেদিকে তাকানো যায় সিলেট; কেবলই সিলেট। আলী আমজদের ঘড়ি, সুরমা ব্রিজ, বন্দর বাজার, চা বাগান, মনীষীদের বিশাল বিশাল ছবি বাইরে, ভেতরে যেদিকে তাকানোা গেছে অভ্যাগতদের চক্ষু স্থীর হয়ে গেছে আর ভাবিত করেছে কি করে এতকিছুর আয়োজন সম্ভব হলো!

অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সূচনা ছিল চমকে দেবার মতো। দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি এর আগে উত্তর আমেরিকায় এমন সূচনা বাঙালিরা কখনও দেখেননি। বিশিষ্ট নৃত্যগুরু তাপস দেবের পরিকল্পনা এবং পরিচালনায় যখন মনিপুরী নৃত্যের ঝলক নিয়ে শিল্পীরা মঞ্চে উঠলো দর্শকরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ভাবছিলেন এটা বোধহয় বলিউডের কোন ছবি থেকে নেয়া অথবা ভারতীয় কোন অঞ্চলের নৃত্য। যখন তারা শুনলেন এটা সিলেটের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ তখন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। না করারই কথা! স্বয়ং কবিগুরুও যে বিস্মিত হয়েছিলেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯২০ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যখন সিলেট আসেন তখন এই নৃত্য দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে পরবর্তীতে তিনি বিশ্বভারতীতে মনিপুরী নৃত্যের প্রচলন করেন এবং এই অঞ্চল থেকে দুইজন প্রশিক্ষক নিয়ে যান সেখানে। ধারাবাহিকভাবে সিলেটের সংস্কৃতির নমুনা তুলে ধরা হয়েছিল এ নৃত্য আলেখ্যতে যা আবাল বৃদ্ধ বনিতাদের ভাল লেগেছে। সমৃদ্ধশালী সিলেটের ইতিহাসের ভাণ্ডার থেকে যেন একটি একটি করে পাতা তুলে ধরা হয়েছিল সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ধামাইল, বিয়ের গান, বাউল, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারিফতি, দেহতাত্বিক থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্বেলিত করা গান নিয়ে সাজানো অনুষ্ঠান উপস্থিতিদের চোখেমুখে বিস্ময়ের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। অনুষ্ঠানটি সাজাতে গিয়ে সুনামগঞ্জের সন্তান তাপস দেব নিজের পকেট থেকে কয়েক হাজার ডলার খরচ করেছেন। দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। সম্মেলনের সফলতায় তার সে পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।

শনিবার বিকেল ৫টায় প্রধান অতিথি টরন্টোর মেয়র জন টোরির শুভেচ্ছা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। মূল বক্তা ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান। বক্তব্য রাখেন, কনভেনর রাশেদা কে চৌধুরি, সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. এ কে মোমেন, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকার সভাপতি সি এম তোফায়েল সামী, সংগঠনের সাবেক সভাপতি এনাম আহমেদ চৌধুরি, সহ সভাপতি কাইয়ুম চৌধুরি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ড. আবু তারিক, জালালাবাদ এসোসিয়েশন নিউইয়র্কের সভাপতি বদরুল হোসেন খান, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল চৌধুরি প্রমুখ। এরপর পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় যুক্তরাজ্য থেকে আগত টাওয়ার হেমলেটের প্রাক্তন মেয়র অহিদ আহমদ সহ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিবৃন্দদের।

সম্মেলন শেষে টরন্টোর নগর পিতা এক টুইট বার্তায় সিলেট সম্মেলনের ছবি ও তার ভাললাগার কথা ব্যক্ত করেন।

চতুর্থ বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ছিল সেমিনার পর্ব। সুরমা অডিটোরিয়ামে দুইদিনে বেশ কয়েকটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। হলভর্তি দর্শক এসব সেমিনার উপভোগ করেন এবং প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহন করেন।
প্রথম দিনে ‘ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে সিলেট’ শীর্ষক সেমিনার দিয়ে এ পর্বের সূচনা করা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক তাজুল মোহাম্মদ, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অমেলেন্দু চক্রবর্তী ও ড. সুশীতল সিনহা চৌধুরি। সঞ্চালনায় ছিলেন ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ।

‘সাংবাদিকতায় সিলেট’ শীর্ষক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন, কলকাতা থেকে আগত যুগশঙ্খ পত্রিকার মুখ্য প্রতিবেদক রক্তিম দাশ ও তাজুল মোহাম্মদ। পরিচালনায় এজাজ চৌধুরী আর সঞ্চালনায় নজরুল মিন্টো।

ডা. শামসুল জায়গীরদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় ‘সিলেটের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক’ সেমিনার। এতে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. এহতেশামুল চৌধুরি।

সিলেটের পর্যটন, পরিবেশ বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ থেকে আগত বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে (বাপা)-র যুগ্ম সম্পাদক শরিফ জামিল, ড. সাঈদুর চৌধুরি শহীদ ও প্রকেৌশলী সৈয়দ আব্দুল গফফার। সঞ্চালনায় ছিলেন নিউইয়র্ক থেকে আগত রানা ফেরদৌস চৌধুরি।

‘আসামের সমস্যা ও অধিকার সংরক্ষণ’ বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন শিলচর থেকে আগত সেপারেট বরাক কমিটির সভাপতি শুভদীপ দত্ত ও কলকাতা থেকে আগত সাংবাদিক রক্তিম দাশ। সঞ্চালনায় ছিলেন ইন্তিখাব চৌধুরি তুহিন।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে সকাল ১১টা থেকে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমেই ছিল ‘হাউ টু ইম্প্রুভ দ্য গ্লোবাল ইমেজ’ শীর্ষক সেমিনার। এতে মূল বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলিকুজ্জামান আহমেদ। অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ড. আবু তারিক এবং সঞ্চালনায় ছিলেন নিউইয়র্ক থেকে আগত বিশিষ্ট উপস্থাপক ও সংস্কৃতি কর্মী নজরুল কবীর।

এরপর অনুষ্ঠিত হয় ‘সিলেটি প্রবাদ প্রবচণ এবং নাগরি লিপি’ বিষয়ক সেমিনার। এতে অংশগ্রহণ করেন গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অমলেন্দু চক্রবর্তী, নিউজার্সি থেকে আগত সালাউদ্দিন আহমেদ, অটোয়া থেকে আগত মহসীন বখত। সঞ্চালনায় ছিলেন নজরুল মিন্টো।

রাশেদা কে চৌধুরির সঞ্চালনায় তরুণ প্রজন্মের সফল ব্যক্তিদের নিয়ে সেমিনার ‘ইয়াং লিডার্স ফোরাম’-এ অংশগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত ড. কাজী রুশদি আহমেদ, আমেরিকান ক্যান্সার সাোসাইটির কমিউনিটি ডেভোলাপমেন্ট ম্যানেজার মাহসোন এন আর চৌধুরি, যুক্তরাজ্য থেকে আগত আবু সালেহ মোহাম্মদ মাসুম, কানাডার ডলি বেগম এমপিপি ও ব্যারিষ্টার ওয়াসিম।

সবশেষে সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ সেমিনারের মূল বক্তা ছিলেন সাবেক সচিব এনাম আহমেদ চৌধুরি।

প্রত্যেকটি সেমিনারের আলোচনা যেমন ছিল আন্তরিক তেমনি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা এক মুহুর্তের জন্যও আসন ছেড়ে যাননি। সেমিনারগুলোর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলে মনে করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। একদিকে যেমন ছিল সচেতনতা তৈরি, অন্যদিকে ছিল কিছু পরিকল্পনা, কিছু উদ্যোগ। বাংলাদেশের প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশিদ চৌধুরির দৌহিত্র মাহসোন এন আর চৌধুরি যখন বললেন তিনি সিলেটে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করতে চান তখন তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিতে উঠে দাঁড়ান সিলেটের কৃতি সন্তান বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. এহতেশামুল চৌধুরি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে (বাপা)-র যুগ্ম সম্পাদক শরিফ জামিল যখন সিলেটের নদ-নদীর দুরবস্থার কথা তুলে ধরে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তখন দর্শক-শ্রোতারাও সোচ্চার হয়ে উঠেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলিকুজ্জামান-এর সুযোগ্য পুত্র ড. কাজী রুশদি আহমেদ যখন বলেন, তিনি বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চান, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান তখন করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে সুরমা অডিটোরিয়াম। ‘সাংবাদিকতায় সিলেট’ সেমিনারে সঞ্চালক যখন তুলে ধরেন সিলেটের শতবর্ষের সাংবাদিকতার ইতিহাস তখন গর্বিত হয়ে উঠেন উপস্থিত দর্শক শ্রোতা।

কাব্য জলসা
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে নিউইয়র্ক থেকে আগত কবি তমিজ উদ্দিন লোদীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় কাব্য জলসা। এ পর্বে তুলে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যে সিলেটের কবি-লেখক, গীতিকারদের অবদান। এতে অংশগ্রহণ করেন নিউইয়র্ক থেকে আগত কবি কাজী আতিক, বোষ্টন থেকে আগত তাহমিনা খসরুজ্জামান। কবিতা আবৃত্তি করেন মহসীন বখত, জালাল কবীর ও আব্দুল হাছিব।

মূলধারার অংশগ্রহণ
কানাডার মূলধারার একটি পরিবেশনা ছিল সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ! অন্টারিও সরকারের পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মুন্নি সোবহানির পরিচালনায় হাসন রাজার গানের সাথে এক ডজন ষাটোর্ধ্ব নারীদের দলীয় নৃত্য পরিবেশন অভিভূত করেছে সম্মেলনের অভ্যাগতদের। এটা ছিল বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ পাওয়া। পরিবেশন শেষে করতালি যেন থামতেই চায় না। এমন পরিবেশনা জীবনে খুব কমই দেখেছেন বলে মন্তব্য উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের।

জানেন কি?
বাংলাদেশের স্বনামধন্য পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো ৪র্থ বিশ্ব সিলেট সম্মেলন উপলক্ষে তাদের উত্তর আমেরিকা সংস্করণে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। এতে সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পর্যটন, শিল্প-বানিজ্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। এটাও চতূর্থ বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের জন্য বিশেষ সম্মান বলে মনে করেন আয়োজকরা।

স্মৃতি জাগানিয়া
অনেকেরই ধারণা সিলেটিরা বড়ই রক্ষণশীল। বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে কনভেনর রাশেদা কে চৌধুরি, উপস্থাপিকা রানা ফেরদৌস, প্যানেল মেয়র ডেইজি সারওয়ার, সিএম তোফায়েল সামী, ডা. জিয়াউদ্দিন, ড. অমলেন্দু চক্রবর্তী, বদরুল খানসহ শত শত হিন্দু-মুসলিম নারী-পুরুষ একে অন্যের হাত ধরে যখন মঞ্চের সামনে ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করছিলেন তখন আর ভাববার অবকাশ থাকলো না যে এ ধারণা ভুল। উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি কোন অনুষ্ঠানে কেউ কি দেখেছেন এ ধরনের দৃশ্য? বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের এ মধুর স্মৃতি অংশগ্রহণকারী, আয়োজকবৃন্দ এবং অভ্যাগতদের মনে থাকবে যুগ যুগ ধরে।


Back to top button