বর্তমান সময়ে বিশ্বের মানুষ খুব বেশি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। মানুষের প্রযুক্তি জ্ঞান এখন আগের যে কোন সময়ের চাইতে অনেক অনেক বেশি। যে কেউ ২/৩টা ডিভাইস বা ৪/৫টা অ্যাপস অনায়াসে চালাতে পারেন। এর জন্য কোনো ডিপ্লোমা বা ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। মানুষের প্রয়োজনে মানুষ শিখে নিচ্ছে। মোবাইল, ইন্টারনেট এবং নানান ধরনের ডিভাইস এবং অ্যাপস এখন আর শখের বিষয়বস্তু নয়; এগুলো এখন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে পড়েছে। মানুষের নিত্যদিনের আলাপ আলোচনায় এখন ফেসবুক, ফেসটাইম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার, স্কাইপের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে জুম ও ষ্ট্রিমইয়ার্ড। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বর্তমান সময়ে তাদের সভা, সেমিনার, সাংগঠনিক আলোচনা এবং পরামর্শ জুম বা ষ্ট্রিমইয়ার্ডের মাধ্যমে করছেন।
টিভি চ্যানেলগুলো আজকাল জুম বা ষ্ট্রিমইয়ার্ডের বদৌলতে লাইভ অনুষ্ঠান করছেন। প্রতিদিন ফেসবুক খুললে দেখা যায় বিভিন্ন সংগঠন এবং কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও নানান ধরনের লাইভ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন।বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রযুক্তির সুবিধায় জনজীবনে এক ব্যাপক পরিবর্তন এসে গেছে। উন্নত বিশ্বে এখন আর অফিসে গিয়ে আর হাজিরা দিতে হয় না; ঘরে বসে অফিসের সকল কাজকর্ম হচ্ছে। আগের মতো রেষ্টুরেন্টে বসে সভা সমিতি করার দিন শেষ; কোচিং সেন্টারে গিয়ে আর কোচিং করতে হবে না; শপিং সেন্টারে গিয়ে ঘুরে ঘুরে কেনা-কাটাও আর করতে হবে না। বেশিরভাগ মানুষ ইতিমধ্যে অনলাইনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আজ আমি জুম ও ষ্ট্রিমইয়ার্ডের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা কিভাবে লাইভ অনুষ্ঠানে তাদের পরিবেশনা আকষর্ণীয় করে তুলবেন সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেবো।
জুম বা ষ্ট্রিমইয়ার্ড হচ্ছে এক ধরনের অ্যাপ, যেগুলো ডাউনলোড করা লাগে না, মোবাইল, ট্যাব/প্যাড বা ল্যাপটপ দিয়ে আপনি অংশগ্রহণ করতে পারেন।
যে কোন পরিবেশনার আগে একটা প্রস্তুতি থাকে। সে হিসেবে আপনি নির্দিষ্ট সময়ের ৩০ মিনিট আগে চেক ইন করুন। সাউন্ড, লাইট এবং ভিডিও কোয়ালিটিটা চেক করা আবশ্যিক ধরে নিন। ছোট্ট একটা ভুলে আপনার পরিবেশনা দর্শকদের কাছে বিরক্তির কারণ হতে পারে। মনে রাখবেন এতে আপনার ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব পড়তে পারে। তাই হেলাফেলা না করে আপনি সচেতন থাকুন।
যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি:
১। আপনি যেখানে বসবেন ইন্টারনেট রাউটারটা যেন কাছাকাছি থাকে (ষ্টুডিওতে ঢোকার আগে রাউটারটা রিষ্টার্ট করে নেবেন)। অথবা বড় কোনো কোম্পানীর মোবাইল ডাটা আপনি ব্যবহার করতে পারেন।
২। আপনি যেখানে বসবেন সেখানে টিভি, আইপ্যাড, স্মার্টফোন বা অন্য কোনো ডিভাইস চালাবেন না। ডেস্কটপ/ল্যাপটপে ফেসবুক খোলা থাকলে বন্ধ রাখবেন।
৩। আপনি যদি মোবাইল ব্যবহার করেন এটাকে সোজা করে না ধরে আড়াআড়ি (ল্যান্ডস্কেপ) করে ধরুন। মনে রাখবেন আপনার মোবাইলের “অটোরোটেশন” বাটনটি চাপ দিয়ে এই ফিচারটি অন রাখতে হবে। (ষ্টুডিওতে ঢোকার আগে মোবাইলটা রিবুট/রিষ্ট্রার্ট করে নিন)
৪। লাইভ চলাকালে কোন ফোন এলে আপনি ফ্রিজ হয়ে যাবেন। অতএব পরিচিত কেউ যেনো ঐ সময়টাতে ফোন না করেন সাবধানে থাকবেন। (ওয়াইফাই ব্যবহারকারীরা অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে সিম কার্ড ইনঅ্যাক্টিভ করে রাখতে পারেন।)
৫। মোবাইলটা এমন জায়গায় সেট করবেন যেখান থেকে আপনাকে ভালভাবে দেখা যায়। এবং মোবাইলটা যেন নড়াচড়া না করে। এ ক্ষেত্রে আপনি যদি নিয়মিত ব্যবহারকারী হয়ে থাকেন তাহলে একটি ষ্ট্যান্ড কিনে নিতে পারেন।
৬। হেডফোন/ইয়ারফোন ব্যবহার করবেন। (আপনার হেডফোন/ইয়ারফোন এমনভাবে সেট করবেন যেন এর মাইক্রোফোনের অংশটি আপনার পোষাক, গলার মালা কিংবা আপনার চুলের সাথে ঘষা না খায়।) এটাকে আপনি আপনার শার্ট/পাঞ্জাবি/শাড়ির সাথে পিন দিয়ে আটকিয়ে রাখুন। মনে রাখবেন এ ছোট্ট জিনিষটা একটু নড়াচড়া করলে বাজে শব্দ তৈরি করে আপনার পরিবেশনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। হেডফোন সমস্যা করলে সরাসরি মোবাইলের মাইক্রোফোন ব্যবহার করুন। (সংগীত পরিবেশনকারীরা মনে রাখবেন আপনারা কখনওই বাদ্যযন্ত্রের উপরে মোবাইল রাখবেন না।)
৭। ল্যাপটপ ব্যবহার করলে এর ক্যামেরার রেজুলেশন কেমন দেখে নেবেন। ল্যাপটপটা এমন জায়গায় রাখবেন যেখান থেকে আপনাকে ভালভাবে দেখা যায়। ইচ্ছে করলে এর সাথে হেডফোনও ব্যবহার করতে পারেন। মনে রাখবেন ক্যামেরা যেন আপনার চোখাচোখি থাকে।
৮। আপনার মাথার উপরে বা পার্শ্বে ফ্যান চললে আপনার কথা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসবে। তাই ফ্যান চালাবেন না। জোরে বা শব্দ করে এয়ারকন্ডিশন চললে সেটা কমিয়ে দিন অথবা অসুবিধা না হলে বন্ধ করে দিতে পারেন। খেয়াল রাখবেন আপনার পেছনে যেন লাইট না থাকে। এতে আপনার চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। চেষ্টা করবেন লাইটের সামনে বসতে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আপনার সামনে বা আশে পাশে কেউ যেন না থাকেন অথবা ঘুরাঘুরি না করেন। যিনি আপনাকে সাহায্য করছেন নিজের অজান্তে তার ছায়া আপনার মুখের উপর পড়লে আপনার চেহারা শুধু অস্পষ্ট হয় না, এক ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
৯। আপনার পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডটি সাদামাটা রাখবেন। কোনো ধরনের বিছানার চাদর বা আলপনা আঁকা কিছু ঝুলিয়ে দেবেন না। মনে রাখবেন আপনি আপনার ঘর থেকে লাইভে যোগ দিয়েছেন ষ্টুডিও থেকে নয়। অতএব যদি মনে করেন ভালভাবে ঢাকা যাচ্ছে না তাহলে যা আছে তাই থাকুক।
১০। মনে রাখবেন অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত আপনি ক্যামেরায় আছেন অতএব আপনি এদিক ওদিক তাকাবেন না, কারো সাথে ইশারায় বা ফিসফিস করে কথা বলার চেষ্টা করবেন না, নড়া চড়া করতে (বডি ল্যাঙ্গুয়েজ) কেয়ারফুল থাকবেন।
১১। আপনি কিছু বলতে চাইলে আপনি যে কোনো সময় লাইভে থেকেই নিঃসংকোচে বলুন। ন্যাচারাল মনে হবে।
১২। জরুরি প্রয়োজনে উপস্থাপককে কোনো বার্তা দিতে চাইলে আপনি ষ্ট্রিমইয়ার্ডের “প্রাইভেট চ্যাট” ব্যবহার করতে পারেন।
১৩। পোষাকের বিষয়ে সচেতন থাকবেন। যেহেতু অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখানো হচ্ছে অতএব সাজ-সজ্জার বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের সচেতন থাকা উচিত।
১৪। আপনি যে কোন ধর্মের অনুসারী হোন; কালচারাল লাইভ অনুষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় কোনো চিহ্নকে প্রাধান্য না দেয়াই উত্তম। বিষয়টা গুরুত্বের সাথে প্রত্যেকের শিল্পীর বিবেচনা করা উচিত।
১৫। লাইভ অনুষ্ঠান চলাকালে কোনো খাবার খেতে যাবেন না। অনুষ্ঠানে আপনি পানি, চা/কফি পান করতে পারেন তবে বোতল মুখে নিয়ে পানি পান করতে যাবেন না। দেখতে বিশ্রি লাগে। গ্লাসে পানি রাখুন।
১৬। কোনো অসত্য তথ্য দেয়া থেকে বিরত থাকবেন। আপনার ভুল তথ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে এবং এতে আপনি আপনার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। মনে রাখবেন লাইভ অনুষ্ঠানগুলো বিভিন্নভাবে রেকর্ড হয়ে থাকে।
১৭। বর্ণবাদী বক্তব্য, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে উস্কানীমূলক বক্তব্য থেকে বিরত থাকবেন। কোনো জাতি, গোষ্ঠীকে আক্রমন করে কথা বলবেন না। এতে আপনি আইনি ঝামেলায় ফেঁসে যেতে পারেন।
১৮। সহশিল্পী ও দর্শক-শ্রোতাদের সম্মান প্রদর্শণ করা বাঞ্ছনীয়।
১৯। সবসময় হাসিখুশি থাকবেন।
আপনার পরিবেশনা যাতে ক্রুটিমুক্ত এবং শ্রুতিমধুর ও দৃষ্টি নন্দন হয় সে জন্য এ পরামর্শগুলো দেয়া হলো।
নজরুল মিন্টো: সার্টিফাইড ইন্টারেক্টিভ ডিজিটাল মিডিয়া এক্সপার্ট