
পূর্ব লন্ডনের বো এলাকা—একটি পুড়তে থাকা শহরের হৃদয় যেখানে বহু অভিবাসী আশ্রয় খুঁজেছে, স্বপ্ন গড়েছে, আবার সেই স্বপ্নই কোথাও ধুলোয় মিশে গেছে। ছোট ছোট টেরেসড হাউজ, দুপাশে রঙিন পর্দা টাঙানো জানালা, দেয়ালে ঝোলানো পিতৃপুরুষের ছবি আর তার নিচে ফুটন্ত দুধ চায়ের গন্ধে ভরা প্রাত্যহিকতা—এই ছিল নাজিয়া বেগমের বাসস্থান। এখানে দিনের আলো এসে ছুঁয়ে যেত জানালার কাঁচ, আর সন্ধ্যায় একলা মা তার মেয়েদেরকে গল্প শোনাতে বসতেন।
এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা বাংলাদেশি কমিউনিটি যেন ছোট এক টুকরো সিলেট। স্থানীয় মসজিদ, বাংলা স্কুল আর হালাল মাংসের দোকান —সবই মিশে আছে এই এলাকাবাসীর জীবনের ছন্দে। কিন্তু এই বাহ্যিক রঙের পেছনে অনেক অন্ধকারও জমে থাকে, যেগুলো কখনো প্রকাশ পায় না।
নাজিয়া ছিলেন এই কমিউনিটির এক সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণী। সদ্য কৈশোর পেরোনো এক মুখ, চোখে ভরপুর স্বপ্ন। ২০১৫ সালে তার বিয়ে হয় মোহাম্মদ আনহার আলীর সঙ্গে, যিনি তখন বাংলাদেশ থেকে এসে যুক্তরাজ্যে পা রাখেন। ঘরজামাই হিসেবে ওঠেন নাজিয়াদের বাসায়। আনহার ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির, আর নাজিয়া ছিলেন প্রাণবন্ত, স্বাধীনচেতা। দুজনের এই পার্থক্যই এক সময় অদৃশ্য শৃঙ্খলে রূপ নেয়।
বিয়ের কিছুদিন পরেই নাজিয়া বুঝতে পারেন, আনহার একজন অন্যরকম মানুষ। তার পোশাক, কথাবার্তা, চলাফেরা—সবকিছুতেই ছিল প্রশ্ন, সন্দেহ আর শাসনের ছায়া। ভালোবাসার জায়গা জুড়ে যেন শাসন, নিয়ন্ত্রণ আর দৃষ্টির অসহ্য ভার জমে উঠছিল। এই অসহনীয় নিয়ন্ত্রণের ভার আর যেন বইতে পারছিলেন না নাজিয়া। তিনি আনহারের কাছ থেকে মুক্তি পেতে চান। অর্থাত্ তালাক।
আলী অভিযোগ করেন, স্ত্রীকে ‘ঝাড়ফুঁক’ বা ‘এক্সরসিজম’ করতে হবে। স্ত্রী তালাক চেয়েছেন—এটুকু তার জন্য ছিল অমার্জনীয়। ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ তাদের সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ে। আনহার বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
২০১৬ সালে প্রথম কন্যার জন্ম, তারপর ২০১৮ সালে দ্বিতীয় কন্যা। অল্প বয়সে বিয়ে, দ্রুত গর্ভধারণ, ও একের পর এক সাংসারিক দায়িত্ব—নাজিয়ার জীবন যেন এক টান টান দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে যাওয়া। তারপরও তার সন্তানেরা যেন মানুষ হয়ে উঠতে পারে—এটাই ছিল তার আরাধ্য।
নাজিয়া নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। মেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়া, বাসার সব কাজ সামলানো, আর স্থানীয় একটি কেয়ার হোমে পার্ট-টাইম কিচেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে তিনি সংসার চালাতেন। প্রতিদিন সকালে মেয়েদের নাস্তা বানিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে নিজে কাজে যেতেন—সেখানে বৃদ্ধদের জন্য রান্না করতেন, থালা বাসন পরিষ্কার করতেন, মাঝে মাঝে হাসিমুখে কাউকে এক কাপ চা দিতেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবার মেয়েদের পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া সামলাতেন। সেই নিরলস পরিশ্রমের মাঝেও তিনি খুঁজছিলেন একটু সম্মান, একটু প্রশান্তি। কিন্তু আনহার এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি। তার চোখে এটি ছিল অবাধ্যতা ও অপমান।
২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর। আনহার আলী যান তার শ্বশুরবাড়ি। স্ত্রীকে বলেন—“আমি তালাক মেনে নিয়েছি।” এক মুহূর্তের জন্য যেন বন্ধ দরজার ওপাশে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচার স্বস্তি খুঁজে পান নাজিয়া। কিন্তু সেটি ছিল এক অভিনয়ের ভেতর চলা প্রতিশোধের সূচনা।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন সন্ধ্যায় আলী লুকিয়ে ছিলেন নাজিয়ার ঘরের আলমারিতে। হাতে দুটি ছুরি, বৈদ্যুতিক তার, আর একটি ওড়না। দশ ঘণ্টা অপেক্ষার পর, যখন দুই শিশু ঘুমিয়ে পড়ে, তিনি বেরিয়ে এসে প্রথমে ঘুষি মারেন নাজিয়ার মাথায় ও পাঁজরে। তারপর ওড়না দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যায়, ঘড়ির কাঁটা থমকে যায়।
একটা ভিডিও মেসেজ ঠিক তার আগে নাজিয়া পাঠিয়েছিলেন বোনকে—“তুমি আমাকে আর দেখতে পাবে না।” সেই ভিডিও এখন এক নীরব সাক্ষ্য—একজন নারীর শেষ আর্তনাদ।
তারপর আলী তার স্ত্রীর নিথর দেহটি একটি সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। সন্তানদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়েন। সকালে পুলিশের কাছে ফোন করে বলেন, “Hello. I accidentally strangled my wife with a scarf.”
তিনি তখন চা খাচ্ছেন। পুলিশ আসলে দরজা খুলে বললেন, “দয়া করে চুপ থাকুন, বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে।”
এমন নিষ্ঠুর আত্মসমর্পণের ছবি সভ্যতার মুখে এক থাপ্পড়। নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে এক কাপ চায়ের আয়েশ—এই প্যারাডক্সই হয়তো আমাদের সমাজের বাস্তবতা, যেখানে নারী এখনো নিজের জীবনযাপন বেছে নিলে সেটা হয়ে দাঁড়ায় অপরাধ।
পুলিশ আসার পর তিনি নিজেই দেখিয়ে দেন স্ত্রীর নিথর দেহ। সাদা চাদরে ঢাকা সেই শরীরকে দেখে বোবা হয়ে যান সবাই।
খবর ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি পাড়ায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই চুপ। মসজিদের ইমাম চোখ ভেজান সেজদায়। মায়েরা মেয়েদের গালে হাত রেখে বলে, “মেয়ে হয়ে নিজের ভালো বুঝতে শিখো।”
এক প্রতিবেশী বলেন, “নাজিয়া তো সেই মেয়ে, যে সবার জন্য দোয়া করতো। নিজের জন্য কিছু চাইতো না। মায়া ছিল তার চোখে, সাহস ছিল তার কণ্ঠে।”
নাজিয়া ছিলেন একজন স্বপ্নবতী মা। তিনি প্রতিদিন মেয়েদের নিয়ে পরিকল্পনা করতেন—”একজন ডাক্তার হবে, আরেকজন কবি। তিনি মেয়েদের রাতের ঘুমে চুলে বিলি কেটে বলতেন, “তোমরা ভয় পেও না, আমি পাশে আছি।”
নাজিয়া বেগম হত্যার পরপরই লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের হোমিসাইড ও মেজর ক্রাইম কমান্ড বিভাগ তদন্ত শুরু করে। আনহার আলীকে গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনাস্থল থেকেই, যেখানে তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলেন, “আমি ভুল করে আমার স্ত্রীকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করেছি।”
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয় এই চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারকার্য। স্থান: ঐতিহাসিক ওল্ড বেইলি আদালত। জনাকীর্ণ কোর্টরুমে যখন আনহার আলী কাঠগড়ায় দাঁড়ান, তখন এক ভয়ার্ত নীরবতা নেমে আসে। আদালতের দেয়ালে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এক বাঙালি নারীর অপ্রকাশিত কান্না।
আলী প্রথমে হত্যার কথা স্বীকার করলেও, তিনি দাবি করেন এটি ইচ্ছাকৃত নয়। কিন্তু প্রসিকিউশন পক্ষ তার পূর্বপরিকল্পিত লুকিয়ে থাকা, অস্ত্র ও গলায় প্যাঁচানো ওড়না, এবং হত্যার পর শান্তভাবে চা খাওয়া ইত্যাদি প্রমাণ তুলে ধরে বলেন—”এটা ছিল এক নির্মম ও উদ্দেশ্যমূলক খুন।”
বিচারক হানারেবল ওয়েন্ডি জোসেফ কিউসি রায়ে বলেন: “আনহার আলী মানতে পারেননি যে একজন নারী নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বিচ্ছিন্ন হতে পারে, নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে। এটা একটি সমাজিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি, এবং তার শাস্তি হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক।”
২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল আনহার আলীকে ২৬ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আদালতের ভেতরে তখন ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন নাজিয়ার মা।
নাজিয়ার মা জানাহারা বেগম বলেন: “আমার নাতনিরা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করে, ‘মা কবে স্বর্গ থেকে ফিরে আসবে?’ আমি কীভাবে বুঝাবো—তাদের মা আর কখনো আসবে না?” “আমি তো এই ছেলেকে ঘরে এনেছিলাম, জামাই করে—সে-ই আমার মেয়েকে খুন করলো!”
নাজিয়ার হত্যাকাণ্ড ও এই মামলার খবর প্রকাশ পায় ব্রিটেনের প্রধান সব সংবাদমাধ্যমে—BBC, The Guardian, Daily Mail, Sky News সহ দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের স্থানীয় পত্রপত্রিকায়। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও এই ঘটনা নিয়ে উঠে আসে তীব্র আলোচনা।
‘সাংবাদিকতা যেন এক অশ্রুসিক্ত দর্পণ’—এই ঘটনার ক্ষেত্রে তা-ই প্রমাণিত হয়। অনেক ব্রিটিশ পত্রিকা এটি ‘honour-based killing’ বলে আখ্যা দেয়। তবে নাজিয়ার পরিবার ও প্রগতিশীল মহল জানিয়ে দেয়—এটা সম্মান নয়, এটি স্পষ্ট নারী-বিদ্বেষ।
কমিউনিটির নেতারা বলেন, “আমরা যারা বিদেশে এসে বসতি গড়েছি, তারা যেন ভুলে না যাই—এই সমাজে সম্মান মানে স্বাধীনতা দেওয়া, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া নয়।”
পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী এবং সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় সোচ্চার হন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #JusticeForNazia হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানান।
একদিন পূর্ব লন্ডনের সেই খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নাজিয়া মেয়েদের বলেছিলেন—‘তোমরা একদিন নিজেকে নিয়ে গর্ব করবে।’ আজ সেই মায়া-মাখা কথাগুলো ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়—নীরবে, অবিরাম।