সম্পাদকের পাতা

মাই ফাদার ওয়াজ এ নাইস গাই

নজরুল মিন্টো

শীতকাল মানেই টরন্টো যেন এক রূপকথার শহর। বেলা দুপুর হলেও সূর্যের আলো যেন চুপিসারে কুয়াশার চাদরে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। আকাশটা থাকে ধূসর, অথচ তার গায়ে এক নিস্পাপ কোমলতা—যেন শিশুর নিঃশ্বাসে জমে থাকা সাদা সাদা বাষ্প। রাস্তার ধারে গাছেরা দাঁড়িয়ে থাকে পাতাহীন নীরবতায়, ডালপালায় জমে থাকে ঝরে পড়া বরফের নকশা।

চা বা কফির কাপে ধোঁয়া ওঠে প্রতিটি অফিসের ডেস্কে, আর জানালার পাশে বসে থাকা কেউ হয়তো একমনে নিচের তুষার ঢাকা রাস্তায় চোখ রাখে। স্ট্রিটকার বা বাসগুলো সময়মতো চললেও তাদের চাকায় জমে থাকে বরফের ধুলো। মানুষ হাঁটে সাবধানে—জুতোয় পুরু তলা, গায়ে গাঢ় রঙের কোট, মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস, আর মুখ ঢাকা উলের স্কার্ফে। এত কিছুর পরও, কারও কারও নাক লাল হয়ে ওঠে ঠান্ডায়।

শীতের দুপুরে টরন্টো নিস্তব্ধ, অথচ তার এই নিঃশব্দতা যেন শব্দের চেয়েও বেশি বলিষ্ঠ—এই শহর তার শীত-শীত আলোয় কী যেন বলে যায়। এমনি কোনো একদিনে, আমার জীবনের এক মুহূর্তে দেখা হয়ে যায় এমন একজনের সঙ্গে—যার মুখে ছিল না কোনো নাটকীয়তা, ছিল কেবল সত্যিকারের ভালোবাসা।

আজকাল অফিসপাড়ায় এক ধরনের ফেরিওয়ালাদের দেখা যায়। এরা হ্যান্ড ব্যাগে করে নানা ধরনের জিনিস নিয়ে ঘোরে। ক্যালকুলেটর, ঘড়ি, খেলনা, গিফট আইটেম ইত্যাদি। বাজারে যে জিনিসটির দাম চল্লিশ ডলার তারা বিক্রি করে পাঁচ থেকে দশ ডলারে। আমি প্রায়ই এসব জিনিস কিনে আলমারিতে ভরে রাখি। কোনো অতিথি এলে উপহার হিসেবে দিই।

সেদিন ১৫-১৬ বছরের একটি ছেলে এলো। দেখেই ধরে নিলাম সে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের হবে। সে যে জিনিস এনেছে, সেগুলো খুব একটা দরকারি নয়। ছোট বৈদ্যুতিক ফাউন্টেন।

ছেলেটির বয়স এবং রং দেখে জিজ্ঞেস করলাম সে কোন দেশের, কোথায় লেখাপড়া করে। প্রথমে উত্তর দিলো, সে কানাডিয়ান যেহেতু তার জন্ম এখানে হয়েছে; তারপর বললো তার পিতা পাকিস্তানি, মা শ্রীলঙ্কান। সে হাইস্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র।

লেখাপড়া ছেড়ে এগুলো বিক্রি করতে এসেছো কেন এবং কেমন কমিশন পায় জিজ্ঞেস করলে ছেলেটি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো এভাবে- প্রতিটি আইটেমে সে দু’ডলার করে পায়। সে তার মাকে সাহায্য করার জন্য এগুলো বিক্রি করতে বেরিয়েছে। তার বাবা খুবই ভালো মানুষ, তবে তাদের সঙ্গে থাকে না এবং কোথায় আছে সে জানে না।

তার কথা থেকে যেটুকু বুঝলাম, তা হলো- তার যখন চার বছর বয়স, তখন দুটি সন্তান ও স্ত্রীকে ছেড়ে সেই ‘ভালো মানুষ’টি অন্যত্র চলে গেছে; তাদের আর কোনো খোঁজখবর সে নেয় না। আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে অন্তত পাঁচবার বললো তার বাবা খুবই ভালো মানুষ ছিল।

ছেলেটি অন্য কানাডিয়ান ছেলেমেয়েদের মতো খুবই স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলছিল কিন্তু আমার চোখ কেন জানি ছলছল করে উঠলো। যদিও আমি প্রথমে কিনবো না বলেছিলাম, এবার তাকে বললাম আমাকে দুটো ফাউন্টেন দাও। ছেলেটি খুব খুশি হলো এবং তার পাওনা বুঝে নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো।

সারাটা দিন কোনো কিছুতেই মন বসলো না। ছেলেটার চেহারা বারবার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে।‘মাই ফাদার ওয়াজ এ নাইস গাই’- পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার কী আকুতি!

স্বার্থপর লোকটি তাদের ছেড়ে চলে গেছে তারপরও পিতার প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই। ভাবছি কী কষ্ট করেই না তার মা তাদের বড় করে তুলছেন। সংসারে কষ্ট আছে বলেই তুষার মাড়িয়ে এই ঝড়ো হাওয়ায় ছেলেটি দুটো ডলারের জন্য অফিসে অফিসে ধর্না দিচ্ছে। মনের কষ্ট, সংসারের কষ্ট, শারীরিক কষ্ট ঢেকে রেখেই ছেলেটি আমার সঙ্গে কথা বলে গেলো। আর বারবার বললো, ‘মাই ফাদার ওয়াজ এ নাইস গাই’।

পৃথিবীতে কেউ কেউ জন্ম নেয় বোঝা নিয়ে, দায়িত্ব নিয়ে—যাদের কৈশোরে নেই ঝলমলে স্মৃতি, নেই বাবার হাত ধরে হেঁটে যাওয়া কোনো বিকেল। কিন্তু তবু তারা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, ক্ষমা করে দেয়… অবলীলায়। এই নিঃশব্দ ক্ষমা, এই নিঃশর্ত ভালোবাসা—আমাদের শেখায়, সম্পর্কের মর্ম কী, অনুপস্থিতির মাঝেও হৃদয়ের টান কতটা গভীর হতে পারে।

ছেলেটির মতো হাজারো কিশোর হয়তো প্রতিদিন হেঁটে চলে এই শহরের অলিগলিতে, বহন করে যায় নীরব কান্না, ঠান্ডা রাস্তায় ফেলে আসে উষ্ণ চিহ্ন। আমরা দেখি না, শুনি না—কিন্তু তারা থেকেই যায়। হয়তো কোনো এক শীতের দুপুরে, কোনো এক অফিসের দরজায়, তারা এসে কড়া নাড়ে—আর আমাদের ভিতরকার মানুষটাকে জাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ চলে যায়।

ছেলেটি চলে গেছে কিন্তু রেখে গেছে তার কষ্টের একজন অংশীদার আমাকে।


Back to top button

দয়া করে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের অনুমতি দিন

দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিজ্ঞাপন ব্লকার ব্যবহার করছেন। আমরা বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করি ওয়েবসাইটের ফান্ডের জন্য