সম্পাদকের পাতা

প্রাণীর প্রতি ভালবাসা

নজরুল মিন্টো

ইউরোপ-আমেরিকার সৌখিন নাগরিকরা ঘরে পোষা প্রাণী রাখেন। এখানকার সমাজে এটা অতি সাধারণ একটা বিষয়। প্রাণীর প্রতি ভালবাসা থেকে অনেকে রাখেন। কেউ কেউ প্রয়োজনের তাগিদেও রাখেন। অন্ধ লোকদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় কুকুর। এরা এতোই ট্রেনিংপ্রাপ্ত যে বাসের নম্বর, হাসপাতাল, সুপার মার্কেটের নাম পর্যন্ত মুখস্ত।

পুলিশ বিভাগে যেসব কুকুর রাখা হয় তারা আরও অগ্রসরমান। ড্রাগস, অস্ত্র, খুনি, বা নানান ধরনের অপরাধীকে চিহ্নিত করতে এদের জুড়ি নেই। মাটির নীচে পুঁতে রাখা ড্রাগস এরা সহজেই চিহ্নিত করে ফেলে। সেনবাহিনীতে এমন কিছু কুকুর রয়েছে যারা অফিসার রা্যাংকের মর্যাদা পেয়ে থাকে। অসাধারণ তাদের প্রতিভা।

সন্তানাদি নেই, বিয়ে হয়নি এমন লোক ছাড়াও বৃদ্ধ লোকেরাও কুকুর বা বেড়াল পোষেন। শুধু পোষাই নয়, এদের জন্য তাদের যথেষ্ট ভালবাসা রাখেন। মৃত্যুর পূর্বে ধনসম্পত্তি ছেলে মেয়েকে না দিয়ে কুকুর-বেড়ালের নামে লিখে যাওয়ার ঘটনাও শোনা যায়।

নানা রঙের, নানা বর্ণের কুকুর বেড়াল দেখা যায়। কোনটার কান খাড়া, কোনটার ঝুলানো, কোনটার মাথায় চুটকী, কোনটার মাথায় এত চুল যে চোখ দেখা যায়না। এছাড়া চিতা বাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ভালুক, বেড়াল এবং একেবারে খরগোশের মতো দেখতে কুকুরও চোখে পড়ে। উত্তর আমেরিকার বেশ ক’টি কোম্পানীর বিজ্ঞাপনে কুকুর ও বেড়ালকে দেখা যায়।

ষ্ট্যাটিসটিক্স কানাডার এক জরিপে জানা যায় যে কানাডার নাগরিকদের ৩৫ শতাংশ লোক কুকুর পোষে থাকেন। সংখ্যার দিক দিয়ে প্রায় ৬০ লক্ষ। তবে বেড়ালের স্থান এ ক্ষেত্রে প্রথম। ৩৮ শতাংশ লোক বেড়াল পোষেন এবং এর সংখ্যায় প্রায় ৮০ লক্ষ। জনমত জরীপে দেখা গেছে, কুকুর মানুষের প্রিয় বন্ধু হিসেবে স্থান পেলেও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বেড়ালের স্থান সব সময়ই শীর্ষে। বেড়ালকে মানুষ খুব ভালবাসে এবং আদর করে।

সম্প্রতি প্রকাশিত পেট ফুড ইন্ড্রাষ্টির সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রায় ৯ কোটি বেড়াল এবং প্রায় ৮ কোটি কুকুর পোষে থাকেন। ইউরোপিয় দেশগুলোতেও বেশির ভাগ নাগরিকরা পোষা প্রাণী ঘরে রাখেন । এশিয়ার মধ্যে জাপান, চিন, দক্ষিন কোরিয়াতে পোষা প্রাণী ঘরে রাখা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। এদিকে অষ্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও ইটালীর নাগরিকরা কুকুর-বেড়ালের চাইতে খাঁচার পাখীর প্রতি দূর্বল বেশি। পাখী এসব দেশগুলোতে প্রিয় পোষা প্রাণী। অনেকে আবার খরগোশ, গিনিপিগ, সাপ এবং অন্যান্য সরিসৃপ জাতীয় প্রাণীও পোষে থাকেন।

কানাডিয়ান অ্যানিমেল হেলথ ইনষ্টিটিউট থেকে জানা যায়, কানাডায় পোষা প্রাণীর ভরণ-পোষণের জন্য প্রতি বছর ব্যয় হয় প্রায় ১৮০ কোটি ডলার। কানাডাতে কুকুর সমিতি, বেড়াল সমিতিও আছে। কুকুর সমিতির নাম কানাডিয়ান ক্যানেল ক্লাব। সমিতি সূত্রে জানা যায় কানাডাতে গত তিন বছর ধরে সবচেয়ে জনপ্রিয় কুকুর হচ্ছে ল্যাব্রাডর। জার্মান শেপার্ড-এর স্থান দ্বিতীয়।
বেড়াল সমিতির নাম কানাডিয়ান ক্যাট সমিতি। এ সমিতি সূত্রে জানা যায়, কানাডার হিমালয়ানস নামক বেড়ালটি জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে পার্সিয়ান এবং তৃতীয় হচ্ছে সিয়ামিজ।

পোষা প্রাণীর জন্য এসব দেশে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল আছে, দোকানে দোকানে ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার আছে। পরিচর্যার জন্য সেলুন আছে, থাকার জন্য হোটেলও আছে। ভাবছেন পোষা প্রাণীর জন্য আবার হোটেল কেন? খুবই প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে এসব হোটেল। মালিক যখন ছুটিতে বা দেশের বাইরে অবস্থান করবেন তখন কে দেখবে এসব পোষা প্রাণীদের? তাই এ ধরনের সুবন্দোবস্ত। আরো মজার বিষয় হচ্ছে শহরে নগরে প্রতি বছর এদের নিয়ে প্রদর্শণী হয় যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক অংশগ্রহণ করে থাকেন।

প্রাণীর প্রতি মানুষের কেমন ভালবাসা এর প্রমাণ পেলাম একদিন। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ডাউন টাউন টরন্টোর একটি গলিতে গাড়ি পার্ক করে এক অফিসে গিয়েছি। ফিরে এসে দেখি আমার গাড়ির পেছনে আরেকটা গাড়ি বে-আইনিভাবে রেখে দিয়ে আমার বেরুবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে পুলিশ ডাকবো কিনা ভেবে একটু সামনে এগুতেই দেখি একটা সাইনবোর্ডে লেখা ‘অ্যানিমেল ক্লিনিক’। ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করতেই এক লোক চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। জিজ্ঞেস করলাম তুমি কাঁদছো কেন? শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে বললো, তার বেড়ালটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে, বাঁচবে বলে আশা কম। আমি তাকে স্বান্তনা দিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, মানুষের প্রতি মানুষের মমতা যেখানে দিন দিন কমে যাচ্ছে সেখানে একটি বেড়ালের অসুস্থতার জন্যও কিছু মানুষ কাঁদে। বেড়ালের জন্যও তাদের বুকে রয়েছে কত ভালবাসা!

পোষা প্রাণীর প্রতি আমার দূর্বলতা আছে। ছোটবেলায় আমার ‘জ্যাক’ নামে একটি কুকুর ছিল। একদিন রাস্তায় তাকে নিয়ে খেলতে গিয়ে আর আমার সাথে সে ফেরত আসেনি। একটি দ্রুতগামী বাস তাকে চাপা দিয়ে চলে যায় এবং সাথে সাথে সে মৃতু্যবরণ করে। আমার এখনও মনে আছে ড্রাইভারটা ইচ্ছে করে তার উপর চাকা তুলে দেয়। রাস্তার ধারে ঘাসের উপর জ্যাক তখন বল নিয়ে খেলছিলো।

এর বহু বছর পর ঢাকার কাঁটাবন থেকে আমি দু’টো জাপানিজ স্পিজ জাতীয় কুকুর কিনে বাড়িতে নিয়ে গেলাম। তখন ‘লায়ন কিং’ ছবিটা কেবল মুক্তি পেয়েছে। ছবির প্রধান চরিত্র ‘সিম্বা’ এবং ‘নালা’র নামে কুকুর দু’টির নামকরণ করলাম। তাদের পরিচর্যার জন্য শ্যাম্পু, চিরুনি থেকে শুরু করে এ জাতীয় কুকুরের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন জানার জন্য কানাডার বুকষ্টোর থেকে বই কিনে আনলাম। সিম্বা এবং নালাকে দেখভাল করার জন্য লোক রাখলাম।

এরিমধে্য কয়েক বছর কেটে গেছে। পরেরবার দেশে গিয়ে দেখি তাদের সংসার বড় হয়ে গেছে অর্থাৎ সিম্বার নালার ঘরে জন্ম নিয়েছে চারটি সন্তান। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুরোধ আসতে লাগলো একটি বাচ্চা কুকুর নেয়ার জন্য। আমি মনে মনে ঠিক করলাম একেকটি ২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করবো। অনেকে কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলো। বাধ সাধলেন আমার মা। তিনি বললেন, ‘দিতে হয় এমনি দিয়ে দাও অর্থের বিনিময়ে কুকুর বিক্রি করে আমি বাড়ির বদনাম হতে দিতে পারি না।’ মা বললেন, আমাদের বাড়ির নাম নাকি হয়ে যাবে- ‘কুত্তা বেচরা বাড়ি’ (কুকুর বিক্রি করা বাড়ি)। পরিবারের মান-ইজ্জত আর থাকবে না। আমি হাসলাম আর ভাবলাম- কত ঠুনকো আমাদের মান-ইজ্জত!

কুকুর নিয়ে বহু গল্প আছে। সর্বশেষ মজার গল্পটি শুনুন আমার কাছ থেকে। অতি সম্প্রতি নিউ ব্রান্সউইকের বাসিন্দা জেমস পল ষ্ট্যানসন নামে এক ব্যক্তির ইচ্ছে জাগলো সে মানুষ খুন করে জেলে যাবে। সে চিন্তা করলো একজন খুন করে জেলে গেলে কয়েক বছর পর ছাড়া পেয়ে যেতে পারে কিন্তু সে আজীবন জেলে থাকতে চায়। এ জন্যে সে ফন্দি করলো একজন নয়; যত বেশি সম্ভব মানুষ নির্বিচারে হত্যা করা যায় সে করবে এবং তারপর জেলে যাবে। এমন একটি ভয়াবহ খুনের নেশা তার মাথায় চাপে এজন্যেই যে তার ইচ্ছে আরাম আয়েশে জীবন কাটানো। আর সে আরাম আয়েশের একমাত্র স্থান হচ্ছে জেল। জেলে কোন কাজ করতে হয় না; সে ফ্রি খাবে আর ঘুমুবে। যথারীতি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে সে গোলাবারুদ, শটগান, রাইফেল আর স্বয়ংক্রিয় পিস্তল জোগাড় করে সোজা চলে আসে টরন্টো। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য যখন সে স্থানীয় একটি পার্কে বসে প্রস্তুত নিচ্ছিল তখন বাগড়াটা বাঁধালো এক কুকুর।

পুলিশ সূত্র জানায়, কুকুরটি তার সাথে এমনভাবে খেলা শুরু করে যে এতে জেমসের মন গলে যায়। সে চিন্তা করলো- না, মানুষ খুন করা যাবে না। সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুলিশ ষ্টেশনে চলে যায় এবং তার পূর্ব পরিকল্পনার কথা সবিস্তারে বলে। পুলিশকে জেমস বললো- যে এলাকার কুকুর এত চমৎকার সে এলাকার মানুষ নিশ্চয় আরো চমৎকার। সুতরাং এই চমৎকার মানুষদের আমি খুন করবো না।

প্রভূভক্ত হিসেবে কুকুরকে নিয়ে কত গল্প, কত ইতিহাস রচিত হয়েছে। কুকুরকে নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রের সংখ্যাও কম নয়। পশ্চিমাদেশগুলোতে কুকুরপ্রীতি দেখে অবাক হতে হয়। মানুষের জন্যও এত দরদ, এত যত্ন দেখা যায় না। স্বীকার করুন আর নাই করুন- কুকুরের মতো প্রভুভক্ত প্রাণী জগতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

সম্প্রতি জার্মানীর একদল গবেষক নতুন কিছু তথ্য দিয়েছেন। তথ্য মোতাবেক আমরা কুকুরকে যতটা বুদ্ধিমান মনে করি তারচেয়ে কুকুর আরও বেশি বুদ্ধিমান। তারা মানুষের দৃষ্টি আর অঙ্গভঙ্গি পাঠ করতে পারে। কুকুরের মস্তিষ্ক এতই ক্রিয়াশীল যে, তারা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নতুন সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।

Back to top button